গত কয়েক দিনের ঘটনাপ্রবাহের দিকে চোখ বোলালে যে কেউ স্বীকার করবেন, গভীর অসুখ হয়েছে পৃথিবীর। দেশে বা বিদেশে—সর্বত্র ধসে পড়ছে মানবিকতা। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যেমন নৈতিকতার স্খলন ঘটেছে, তেমনি সামাজিক পর্যায়েও ঘটেছে। দেশে দেশে একচ্ছত্র অধিপতিদের উত্থান এবং তাদের ক্ষমতা ধরে রাখার প্রয়াসে গুম, নিখোঁজ, হামলা, মামলা, ধর্মের অপব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সামাজিক অস্থিরতা ও নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়। কেনই-বা হবে না? সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, রাষ্ট্র যদি অনৈতিক হয়, সেখানে সমাজ অনৈতিক হতে বাধ্য। আর সে কারণেই বলা হয়, ‘নগর পুড়িলে দেবালয় কি এড়ায়?’
এড়াতে পারে না বলেই দিন কয়েক আগে আমরা দেখলাম, ময়মনসিংহের চর ঈশ্বরদিয়া গ্রামের এক নারীকে হাত-পা বেঁধে শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন ধরিয়ে মেরে ফেলা হলো। ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায় এক শিক্ষককে ক্রিকেট খেলার স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল এক ছাত্র। নড়াইলে এক কলেজ অধ্যক্ষকে পুলিশ এবং হাজারো মানুষের সামনে জুতার মালা গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো।
বিশ্বের যেকোনো চিন্তাশীল মানুষের জন্য এ ঘটনাগুলো উদ্বেগের। কারণ, পৃথিবী যতই ‘সভ্য’ হওয়ার দাবি করছে, ততই নৈতিক মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। গ্লোবাল স্টাডি অন হোমিসাইডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০০ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে পৃথিবীতে সংঘবদ্ধ সহিংসতা বেড়েছে ১৯ শতাংশ। প্রতিবছর এই পৃথিবীতে মারামারি, কাটাকাটি করে মারা যাচ্ছে ৪ লাখেরও বেশি মানুষ।
সামনের দিনগুলোতে পৃথিবী আরও সভ্য হবে। তখন কি সহিংসতা আরও বাড়বে? অসহিষ্ণুতা আরও বাড়বে? নৈতিক মূল্যবোধ আরও কমবে? সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, সেই আশঙ্কা প্রবল।
শুধুই কি প্রযুক্তি দায়ী? না মনে হয়। পুঁজিবাদকেও কিছুটা দায় নিতে হবে। আজ আপনার আশপাশের কাউকে প্রশ্ন করে দেখুন—জীবনের লক্ষ্য কী? অবধারিত উত্তর আসবে, অর্থ উপার্জন। ধনী হওয়া। সমাজের সবকিছুর মানদণ্ড যখন হয় অর্থ-কড়ি, তখন নীতি-নৈতিকতা, মূল্যবোধ-আদর্শ ভূলুণ্ঠিত হওয়াই স্বাভাবিক। যেমনটা বলেছেন কলকাতার লেখক, গীতিকার ও সুবক্তা চন্দ্রিল ভট্টাচার্য—‘একটা সময় ছিল, যখন শিক্ষককে দেখলে এলাকার সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিটিও উঠে দাঁড়িয়েছেন। সালাম দিয়েছেন। আর এখন ছোট ছোট বালক কিশোরেরাও তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে। ‘‘দুই পয়সার মাস্টার, কয় টাকা ইনকাম করে’’ বলে অবজ্ঞা করে। কারণ আগের সমাজ শিক্ষককে বিচার করত মেধা দিয়ে, আর এখনকার সমাজ বিচার করে অর্থকড়ি দিয়ে।’
ধারণা করা যায়, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে পুঁজিবাদের জৌলুশ আরও শনৈঃ শনৈঃ বাড়বে। আর তার চোখ ধাঁধানো জৌলুশে পথ হারাবে সামাজিক মূল্যবোধ।
এসবের জাদুকরী প্রভাব কীভাবে সমাজ থেকে নৈতিক মূল্যবোধকে উধাও করে দেবে তারও ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের কারণে মানুষ বড় বেশি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠবে। সারাক্ষণ ‘আমি আমি’ চিন্তায় মগ্ন থাকবে। ফলে যেকোনো উপায়ে ‘আমি’-কে সুখী রাখতে সে অনৈতিক পথ বেছে নিতে পিছপা হবে না। যে শিক্ষা ব্যবস্থা মানুষকে নৈতিকতার পাঠ দিত, সেই শিক্ষা আরও বেশি বাণিজ্যিক হয়ে উঠবে। পাঠ্যক্রমে মুনাফার উপকরণ বেশি বেশি স্থান পাবে। ফলে বাণিজ্যিক মুনাফা বাড়ানোর প্রয়োজনে মানুষ নীতি-নৈতিকতার ধার ধারবে না।
একটু চোখ-কান খোলা রেখে চারপাশে তাকালেই ড. শোইয়াবের বলা কথার সত্যতা চোখে পড়ে। গত কয়েক দশকের প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার নমুনা। আর গণমাধ্যমের তথ্যসন্ত্রাসের কথা তো বলাই বাহুল্য। এখন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও গণমাধ্যমের অংশ হয়ে গেছে। ফলে তথ্যের অবাধ প্রবাহ ডেকে আনছে নানা বিপদ। উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে অনেকেই ভুয়া খবর ছড়িয়ে সমাজে সৃষ্টি করেছে সংঘাত। আমাদের দেশে যেমন এসব ঘটনার উদাহরণ রয়েছে, তেমনি বহির্বিশ্বেও রয়েছে। অনেক দেশ তাই সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারের আইন তৈরি করছে। তবুও শেষ রক্ষা হবে কি? যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটল হিল দাঙ্গা কিংবা ভারতের নূপুর শর্মা কাণ্ড, বাংলাদেশের রামু-নাসিরনগর কাণ্ডের মতো অঘটনগুলো ভবিষ্যতে আরও বাড়বে বলেই আশঙ্কা করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।
নৈতিক মূল্যবোধ বিসর্জনের পেছনে শিক্ষাকে একটু বেশি দায়ী করেছেন রোশান পারিহার, পুনম পারিহার ও দেবেন্দ্র জিৎ শর্মা নামের তিন গবেষক। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অব কারেন্ট মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড অ্যাপ্লাইড সায়েন্সে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে তাঁরা বলেছেন, নৈতিক মূল্যবোধের পতনের প্রধান কারণ হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বেসরকারিকরণ। এখন অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন ব্যবসায়ী আর শিক্ষার্থীরা গ্রাহক। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মালিকেরা অযাচিতভাবে কোর্স বাড়ায়, শিক্ষকদের কম বেতন দেয়। ফলে শিক্ষকেরাও অনৈতিক অনুশীলনে লিপ্ত হয়। ভবিষ্যৎ পৃথিবীতে নিঃসন্দেহে এসবের চর্চা আরও বাড়বে।
তবে সকল অন্ধকার সুড়ঙ্গের শেষেই থাকে আলোর রেখা। এত যে অস্থির পৃথিবী, পূতিগন্ধময় সহিংস যে ব্রহ্মাণ্ড, সেখানে জাপানে এখনো প্রতি ১ লাখে খুন-হত্যার মাত্রা মাত্র শূন্য দশমিক ২, হংকংয়ে শূন্য দশমিক ৩, ইন্দোনেশিয়ায় শূন্য দশমিক ৪, নরওয়েতে শূন্য দশমিক ৫। এসব দেশে সভ্যতা যে কম বিকশিত হয়েছে, এমন তো নয়। তবে কী এমন তরিকা অবলম্বন করেছে তারা যে, নৈতিক মূল্যবোধ এখনো অক্ষুণ্ন রাখতে পেরেছে? ভবিষ্যতের পৃথিবী হয়তো এসব দেশের দেখানো পথ ধরে সত্যিকার অর্থেই নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন পৃথিবী হয়ে উঠবে।
আশায় বসতি গড়তে দোষ কি!
সূত্র: ওয়ার্ল্ড পপুলেশন রিভিউ, স্পটলাইট, আইজেসিএমএএস জার্নাল, আওয়ার ওয়ার্ল্ড ইন ডেটা ও কুরুক্ষেত্র ইউনিভার্সিটির জার্নাল