রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণ বিশ্ব ব্যবস্থা বদলে না দিলেও এশিয়ার ভূরাজনীতি বদলে যাওয়ার ইঙ্গিত পাচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা। যুদ্ধ শুরুর আগে–পরে রাশিয়ার মিত্র হিসেবে নিজেদের প্রমাণ করেছে চীন এবং বেলারুশ। কিন্তু পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এক সময়ে খুবই কাছের মিত্র কাজাখস্তান ক্রমেই রাশিয়ার মুঠো থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং কাজাখস্তান সফরকালে কাজাখস্তানের ‘জাতীয় স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং আঞ্চলিক অখণ্ডতা রক্ষার’ বিষয়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এই প্রতিশ্রুতিই কাজাখস্তানকে রাশিয়ার মুঠো থেকে বের হয়ে আসার ক্ষেত্রে সাহস জুগিয়েছে।
বিষয়টি চুপিসারে ঘটছে এমন না। ইউক্রেন ইস্যুতে কাজাখস্তানের উচ্চপর্যায়ের কোনো কর্মকর্তাই এখন পর্যন্ত রাশিয়ার পক্ষে মন্তব্য করেননি। বরং দেশটির প্রেসিডেন্ট কাসিম জুমরাত তোকায়েভ জনসমক্ষেই রাশিয়াকে সহায়তার কথা প্রত্যাখ্যান করেছেন। দনবাস অঞ্চল স্বাধীন করতে রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন তো করেনইনি, এমনকি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে উঠতেও রাশিয়াকে কোনো সহায়তা করেনি দেশটি।
কাজাখস্তানের বিরুদ্ধে ইউক্রেনকে অস্ত্র সহায়তা দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল রুশ গণমাধ্যম। কাজাখ প্রতিষ্ঠান টেকনো এক্সপোর্ট সোভিয়েত আমলের বেশ কিছু অস্ত্র–গোলাবারুদ জর্ডান ও যুক্তরাজ্যের মাধ্যমে ইউক্রেনে সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। কাজাখ সরকার বিষয়টি অস্বীকার করেছে। তবে কাজাখস্তান ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাক বা না পাঠাক দেশটি যে রাশিয়ার মুঠো থেকে বের হয়ে আসতে চাচ্ছে তা স্পষ্ট।
তবে রাশিয়ার খপ্পর থেকে বেরিয়ে আসাটা অত সহজ নয়। দেশ দুটির সম্পর্ক কেবল সোভিয়েত আমলের ধারাবাহিকতা নয়। স্বাধীনতার পর থেকেই বিগত তিন দশকে কাজাখস্তান রাশিয়ার কথামতো তার সব জোটেরই অংশ হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে কমনওয়েলথ অব ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেটস (সিআইএস), সাংহাই সহযোগিতা সংস্থা (এসসিও), ইউরেশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়ন (ইইইউ) এবং কালেকটিভ সিকিউরিটি ট্রিটি অর্গানাইজেশন (সিএসটিও)। এসবের বাইরেও দেশটির অর্থনীতি রাশিয়ার ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। খাদ্য–বস্ত্রের মতো মৌলিক অনেক ক্ষেত্রে রাশিয়ার পণ্য ছাড়া কাজাখরা অচল।
রাশিয়া কাজাখস্তানের বৈদেশিক বাণিজ্যের পাঁচ ভাগের এক ভাগের ভোক্তা এবং দেশটির অর্ধেক বাণিজ্যিক কার্গো রাশিয়ার ভূখণ্ড ব্যবহার করে চলাচল করে। কাজাখস্তানের জ্বালানি তেল সরবরাহের সবচেয়ে বড় পাইপলাইন কাস্পিয়ান পাইপলাইন কনসোর্টিয়াম। এর মধ্য দিয়ে দেশটির ৮০ শতাংশ তেল ইউরোপে যায় এবং এই পাইপলাইনের এক-তৃতীয়াংশের মালিক রাশিয়া। ফলে রাশিয়া চাইলেই এই পাইপলাইন হয়ে কাজাখ তেল পরিবহন বন্ধ করার ক্ষেত্রে ভূমিকা নিতে পারে। এই কাস্পিয়ান পাইপলাইন কনসোর্টিয়াম বন্ধ করে দিলে কাজাখস্তানের এক বছরের বাজেটের অন্তত ৪০ শতাংশ আয় বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে এই বিষয়টি কাজাখ নেতারা কোনোভাবেই উপেক্ষা করতে পারবেন না।
কাজাখস্তান বেরিয়ে যেতে চাইলেও রাশিয়া চায় বর্তমান অবস্থা বজায় রাখতে। কারণ বৈশ্বিক নিষেধাজ্ঞার মুখে একঘরে হয়ে পড়ার পর অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে কাজাখস্তান রাশিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র হয়ে উঠেছে। মস্কো নিজেও বুঝতে পারছে, বর্তমানে তার দর-কষাকষির সক্ষমতা যে কোনো সময়ের তুলনায় কম। একই সঙ্গে রুশ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিষেধাজ্ঞার হাত থেকে বাঁচাতে চাইলে রাশিয়ার জন্য আস্তানার সহায়তা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এ ছাড়া রাশিয়ার গুরুত্বপূর্ণ ভূরাজনৈতিক–অর্থনৈতিক জোটগুলো টিকিয়ে রাখার জন্যও কাজাখস্তানের সঙ্গে মৈত্রী জরুরি।
সব মিলিয়ে কাগজে কলমে মস্কো আস্তানার সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সম্পর্ক উন্নয়নের কথা বললেও রাশিয়া যে আক্ষরিক অর্থেই বিরক্ত ও ক্ষুব্ধ তা স্পষ্ট। রাশিয়া এরই মধ্যে কাজাখস্তানের উত্তরাঞ্চলের একটি অংশে ‘রুশদের গণহত্যা’ করা হচ্ছে এই অভিযোগ তুলে ‘নাৎসি মুক্ত’ করার বিষয়ে কথা বলছে। সাবেক রুশ প্রেসিডেন্ট দিমিত্রি মেদভেদেভ এক টুইটে বলেছিলেন, ‘রাশিয়ার উচিত ইউক্রেনের পর কাজাখস্তানের উত্তরাঞ্চলের ভাগ্য নির্ধারণে মনোযোগ দেওয়া।’ যদিও পরে তিনি দাবি করেছিলেন যে, তাঁর অ্যাকাউন্ট হ্যাক করা হয়েছিল।
তবে কেবল ইউক্রেন এবং কাজাখস্তান নয়, রাশিয়ার জন্য আরেকটি নতুন পরীক্ষা হিসেবে হাজির হয়েছে নাগোরনো–কারাবাখ সংকট। সংকটের বিষয়ে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ গত মঙ্গলবার (১৩ সেপ্টেম্বর) বলেছেন, ‘প্রেসিডেন্ট পুতিন উভয় পক্ষকে শান্ত থাকার আবেদন করেছেন।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘এই বিষয়ে রাশিয়া ফেডারেশনের ভূমিকা এবং ব্যক্তিগতভাবে পুতিনের ভূমিকাকে অবমূল্যায়ন করার সুযোগ নেই। প্রেসিডেন্ট পুতিন সীমান্তে উত্তেজনা কমানোর সর্বাত্মক চেষ্টা করছেন।’
তবে পুতিন এবং রাশিয়া যতই চেষ্টা করুক, এই অঞ্চলে রুশ প্রভাব চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে তা নিশ্চিত। কারণ, কাজাখস্তানের পাশাপাশি তুরস্কও এই সংকটে আজারিদের পাশে রয়েছে। অথচ রাশিয়া, আর্মেনিয়া এবং কাজাখস্তান এই তিন দেশই সিএসটিওর সদস্য। ফলে এই জোটে মতানৈক্য রাশিয়াকে নতুন পরীক্ষার মুখেই দাঁড় করিয়েছে।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিংক ট্যাংক জার্মান মার্শাল ফান্ডের ফেলো জোনাথন কাটজ ইউক্রেনে রাশিয়ার সমরশক্তি ক্ষয় এবং নিষেধাজ্ঞার কারণে দেশটির অর্থনৈতিক দুর্বলতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, ‘আমি সত্যিই দক্ষিণ ককেশাসে রাশিয়ার প্রভাব ক্ষয়ে যাওয়া দেখতে পাচ্ছি… এর কারণ শুধু সামরিক ক্ষয়ক্ষতিই নয়, অর্থনৈতিক ক্ষতিও।’
সুতরাং, রাশিয়াকে ঘিরে থাকা বলয়ে মস্কোকে বেশ কয়েকটি পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে একই সময়ে। এসব পরীক্ষাই নির্ধারণ করে দেবে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ অবস্থা। তাই কাজাখস্তান যদি রাশিয়ার মুঠো ফসকে বেরিয়ে যায় এবং তা রুখতে যদি নতুন আরেকটি ফ্রন্টে যুদ্ধ শুরু করতে হয় তা রাশিয়ার জন্য খুবই দুর্ভাগ্যজনক হবে। একই সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত বলয়ে নিজের দুর্বল অবস্থান এবং পূর্ব ইউরোপে দুর্বল অবস্থান দেশটির ঐতিহাসিক প্রতিপক্ষকে আরও এক ধাপ এগিয়ে দিতে পারে। তবে, সবকিছুই নির্ভর করছে রাশিয়া এসব পরীক্ষা কীভাবে সামলায় তার ওপর।
তথ্যসূত্র: ফরেন পলিসি, আল–জাজিরা, বিবিসি