তৃতীয় মেয়াদে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট হলেন রিসেফ তাইয়্যেপ এরদোয়ান। গতকাল রোববার এরদোয়ানের সমর্থকেরা সারা রাত জেগে এ ঐতিহাসিক বিজয় উদ্যাপন করেছেন। রাজধানী আঙ্কারায় নিজ বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে বিজয়ী এরদোয়ান তাঁর উল্লসিত জনতাকে বলেছেন, ‘এ বিজয় তুরস্কের সাড়ে ৮ কোটি মানুষের।’
কিন্তু তাঁর এ দাবি পুরোপুরি সত্য নয় বলে মনে করেন বিশ্লেষকেরা। কারণ, তাঁর প্রতিপক্ষ কেমাল কিলিচদারুগলো এরদোয়ানের জয়কে মেনে নেননি। তিনি বলেছেন, গত কয়েক বছরের মধ্যে সবচেয়ে অগ্রহণযোগ্য নির্বাচন হয়েছে গতকাল।
ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বলেছে, গতকালের দ্বিতীয় দফার নির্বাচনে এরদোয়ান ৫২ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। এটি প্রমাণ করে, প্রায় অর্ধেক ভোটার কর্তৃত্ববাদী শাসক এরদোয়ানকে পছন্দ করেন না।
বিজয়ী হওয়ার পর এরদোয়ান তাঁর প্রতিপক্ষ কেমালকে ‘বাই বাই কেমাল’ বলে কটূক্তি করেছেন। তাঁর সমর্থকেরাও এই স্লোগান দিয়েছিল। এরদোয়ান তাঁর বিরোধী জোটের এলজিবিটিপন্থী নীতিরও নিন্দা করেছেন।
যা হোক, এরদোয়ান তাঁর ক্ষমতাকে আরও পাঁচ বছরের জন্য নিরঙ্কুশ করলেন। তাঁর বিজয় উদ্যাপন করতে এরদোয়ানের প্রাসাদের সামনে আঙ্কারার সর্বত্র থেকে সমর্থকেরা ছুটে এসেছিলেন। তাঁরা ইসলামিক স্লোগান দিচ্ছিলেন।
এ সময় বিজয়ের উল্লাসে আত্মহারা হয়ে অনেক সমর্থক তুরস্কের অর্থনৈতিক সংকট ভুলে ছিলেন। এমনই একজন তরুণ সমর্থক সেহান। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক সংকটের গল্প সবই মিথ্যা। আমরা কেউ ক্ষুধার্ত নেই। আমরা এরদোয়ানের অর্থনীতির নীতি নিয়ে সন্তুষ্ট। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী পাঁচ বছর তিনি আরও ভালো করবেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, মুদ্রাস্ফীতি মোকাবিলায় এখন তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবেন কি না। প্রায় ৪৪ শতাংশ বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির কারণে তুরস্কের নাগরিকদের নাভিশ্বাস উঠছে।
এরদোয়ান সরকারের গোঁড়া নীতির কারণে ও সুদহার না বাড়ানোর কারণে তুরস্কে খাবারের খরচ, বাড়িভাড়া ও অন্যান্য দৈনন্দিন জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে।
ডলারের বিপরীতে তুর্কি মুদ্রা লিরার মান কমতে কমতে রেকর্ড পর্যায়ে নেমে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রার ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
এরদোয়ানের সমর্থকদের মনে অবশ্য এসব অর্থনৈতিক দুরবস্থা নিয়ে দুর্ভাবনা নেই। তাঁরা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে তুরস্কের শক্তিশালী অবস্থান ও কুর্দি ‘সন্ত্রাসীদের’ দমনে এরদোয়ানের সাফল্য নিয়েই গর্বিত।
কুর্দি নেতা সেলাহাতিন ডেমিরতাসকে ২০১৬ সাল থেকে কারাবন্দী করে রেখেছেন এরদোয়ান। তাঁকে মুক্তি দিতে ইউরোপীয় মানবাধিকার আদালত আদেশ দিলেও এরদোয়ান তাতে কর্ণপাত করেননি। বিরোধী নেতা কেমাল কিলিচদারুগলো তাঁকে মুক্তি দিতে আহ্বান জানিয়েছিলেন। এরদোয়ান তাঁর এ আহ্বানেরও সমালোচনা করেছেন।
গত ফেব্রুয়ারিতে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল তুরস্ক ও সিরিয়া সীমান্তে। তখন হাজার হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। বিধ্বস্ত হয়েছে হাজার হাজার ঘরবাড়ি। এরদোয়ান বলেছেন, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলো পুনর্নির্মাণ করা তাঁর অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এ ছাড়া অন্তত ১০ লাখ সিরীয় শরণার্থীকে ‘স্বেচ্ছায়’ তুরস্কে প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তিনি।
এই সবকিছু মিলিয়ে বিশ্লেষকদের ধারণা, তুরস্কের নাগরিকদের মধ্যে এক ধরনের মেরুকরণ হয়েছে। একদল এরদোয়ানকে ভীষণ পছন্দ করেন। আরেক দল ততটা পছন্দ করে না। ফলে বিভক্ত এ জাতির ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আশা খুব একটা নেই।
২০১৬ সালে তুরস্কে একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয়েছিল। এরপর এরদোয়ান প্রধানমন্ত্রীর পদ বিলুপ্ত করেন এবং প্রেসিডেন্ট হিসেবে ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী হন। তিনি আগের চেয়ে অনেক বেশি কর্তৃত্ববাদী হয়ে ওঠেন।
তাঁর এ কর্তৃত্ববাদে অনেকেই অসন্তুষ্ট হন। যেমন গতকাল আঙ্কারার একটি ভোট কেন্দ্রের বাইরে একজন ভোটার বলছিলেন, ‘অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে শুদ্ধি অভিযান শুরু করেছিলেন এরদোয়ান। তখন তুরস্কের মেধাবীরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করতে শুরু করেছিল। আমার আশঙ্কা, মেধা পাচার এখন আরও তীব্র হবে।’
আরও খবর পড়ুন: