চলতি বছরের প্রথম সাত মাসে মাত্র দুদিন বিদেশ সফরে গিয়েছিলেন সি চিন পিং। তাও আবার লাগোয়া রাশিয়ায়। বিষয়টি আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। অনেকেই অনুমান করছেন, চীনের অভ্যন্তরীণ সংকট ক্রমেই বাড়ছে। তাই ঘর সামলাতে ব্যস্ত চীনে প্রেসিডেন্টের বিদেশ সফরে যাওয়া হয়ে উঠছে না।
২০১৩ সাল থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে তিনি অন্তত ১৪ বার দেশের বাইরে গিয়েছেন সি চিন পিং। কিন্তু কোভিড-১৯ মহামারির পর মাত্র একবারই দেশের বাইরে গিয়েছেন তিনি। এখন বিভিন্ন দেশের নেতাদের নিজ দেশেই আতিথেয়তা দিচ্ছেন।
চলতি বছরের এই সাত মাসে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র ও সরকারপ্রধানসহ অন্তত ৩৬টি দেশের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন সি। অথচ, কোভিডের আগে প্রতিবছর একই সময়ে অন্তত ৪৮ জন বিদেশি অতিথির সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন তিনি।
এই দুই পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্টত বোঝা যাচ্ছে, সি চিন পিং ঘরে এবং বাইরে উভয় জায়গায়ই সময় দেওয়া কমিয়ে দিয়েছেন। এমনকি কোভিড মহামারির সময় তিনি ভিডিও কলের মাধ্যমে বৈদেশিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করতেন, এখন সেটিও করছেন না। সর্বশেষ তিনি ভিডিও কলে কথা বলেছিলেন গত বছর, চেক রিপাবলিকের সরকারপ্রধানের সঙ্গে।
বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সি চিন পিংয়ের এই যোগাযোগহীনতা বা কম যোগাযোগ চীনের ওপর সামগ্রিকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে বলে পিউ রিসার্চ সেন্টারের দাবি। সংস্থাটির এক গবেষণা বলছে, বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ ভূ-রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতায় ওয়াশিংটনের চেয়ে পিছিয়ে পড়তে পারে বেইজিং।
তবে ওয়াশিংটনভিত্তিক থিংক ট্যাংক আটলান্টিক কাউন্সিলের গ্লোবাল চায়না হাবের অনাবাসিক ফেলো ওয়েন-টি সুং বলেছেন, ‘এমনটা হতে পারে যে, এখন সির কাছে কূটনীতির চেয়ে অন্য কোনো কাজ বেশি অগ্রাধিকার পাচ্ছে।’ চীনের অর্থনীতি, মুদ্রাস্ফীতি, পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিন গ্যাংকে অপসারণ, দুর্নীতির অভিযোগে দেশের পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কর্মকর্তাদের পদচ্যুত করার বিষয়গুলো উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরেন সুং।
কোভিডের সময় প্রায় টানা ১০০০ দিন চীনা প্রেসিডেন্ট বৈদেশিক সফরে যাননি। তবে চলতি বছরের শুরুর দিকে সব ধরনের কোভিড বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার পর ধারণা করা হচ্ছিল—তিনি হয়তো ঘন ঘন বিদেশ সফরে যাবেন। এমনকি তিনি ২০২২ সালের শেষ দিকে বিধিনিষেধ থাকার সময়ও উজবেকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া এবং সৌদি আরব সফরে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপরই সব বন্ধ, এক রাশিয়া ছাড়া তিনি আর কোথাও যাননি।
তবে সির বিদেশ সফরে না যাওয়ার পেছনে সফরের সময়সূচি বড় একটি কারণ হতে পারে। যেমন, সফরসূচি না মেলায় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জুলাই মাসে ভিডিওর মাধ্যমে দুদিনের সাংহাই সহযোগিতা সংস্থার বৈঠকের আয়োজন করতে বাধ্য হন। তবে এ বছর এখনো বেশ কয়েকটি বড় আন্তর্জাতিক শীর্ষ সম্মেলন, যেমন জি-২০ এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা সংগঠন এবং ব্রিকসের সম্মেলন এখনো বাকি। এরই মধ্যে চলতি মাসে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে অনুষ্ঠেয় ব্রিকসের সম্মেলনে তার যোগ দেওয়ার কথা।
তবে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠেয় হতে এশিয়া-প্যাসিফিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার (এপিইসি) সম্মেলনে তিনি নাও যেতে পারেন। কারণ, হংকংয়ের স্বায়ত্তশাসন খর্ব করায় চীনসমর্থিত প্রশাসক জন লির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে যুক্তরাষ্ট্র। তেমনটা হলে সি সম্মেলনে নাও যেতে পারেন। সেক্ষেত্রে তিনি সরাসরি মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাক্ষাতের সুযোগ হারাবেন।
সব মিলিয়ে সি চিন পিং অনেকটাই ‘ব্যাকফুটে’ রয়েছেন বলে মনে করছেন এশিয়া সোসাইটি পলিসি ইনস্টিটিউটের সেন্টার ফর চায়না অ্যানালাইসিসের চীনা রাজনীতির ফেলো নিল থমাস। তিনি বলেন, চীনের ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক ভাবমূর্তি গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতাদের কাছে সি-কে আমন্ত্রণ জানানো কঠিন করে তুলেছে। সির কোভিড-১৯ মহামারি ব্যবস্থাপনা, ঝিনজিয়াংয়ে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ ও ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়ে পুতিনের নিন্দা করতে অস্বীকৃতি-সবই পশ্চিমের সঙ্গে সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
মহামারির আগে শি চিন পিংয়ের ১৪ শতাংশ সফরই ছিল ইউরোপীয় দেশগুলোতে। ২০১৯ সালে সেই হার ছিল ১৯ শতাংশ। কিন্তু চলতি বছর এই হার কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪ শতাংশে। এখন ইউরোপের নেতারা শির সাক্ষাৎ পেতে খুব একটা আগ্রহী নন। যেমন, যুক্তরাজ্যের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঋষি সুনাক কোনোভাবেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে চীন সফরে যেতে চান না।
তবে যা হোক, আগামী অক্টোবরে অনুষ্ঠেয় চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) শীর্ষ সম্মেলন বিশ্ব নেতাদের একমঞ্চে পাওয়ার বড় সুযোগ দেবে শি চিন পিংকে। তবে কারা এই সম্মেলনে আসবেন বা কারা আসবেন না-তা এখনো নিশ্চিত নয়।
ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়, জার্মানি, ফ্রান্স, গ্রিস এবং চেক রিপাবলিক এই সম্মেলনে আসতে পারে। বিআরআই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেও এই সম্মেলন বয়কট করতে পারে ইতালি। তবে গত মাসে এই সম্মেলনের প্রস্তুতির জন্য সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন সি। কিন্তু অতিথি তালিকায় খুব বেশি মনোযোগ দেওয়ার সম্ভাবনা তাঁর নেই। কারণ তাঁর ঘরেই আসল অশান্তি।
এ বিষয়ে সিঙ্গাপুরের লি কুয়ান স্কুল অব পাবলিক পলিসির সহযোগী অধ্যাপক আলফ্রেড উ বলেন, ‘তাঁর (সি) তৃতীয় মেয়াদের অগ্রাধিকার হলো জাতীয় নিরাপত্তা এবং অভ্যন্তরীণভাবে নিজ শাসনকে সুরক্ষিত করা।’ আলফ্রেড আরও বলেন—‘শি সম্ভবত বিশ্বের দুই নম্বর শীর্ষ নেতা হিসেবে তাঁর মর্যাদা সম্পর্কে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী। তাই তিনি আশা করেন-অন্যরাই তাঁকে দেখতে চীনে আসবে।’
ব্লুমবার্গ থেকে অনুবাদ করেছেন আব্দুর রহমান