চারদিকে বিস্ফোরণের শব্দে কান ঝালাপালা, ঝাঁজালো কালো ধোঁয়ায় আচ্ছাদিত আকাশ। বুলেট ও রকেট হামলার আশঙ্কায় অনিশ্চয়তার মধ্যে প্রতিদিনের জীবনযাপন। সুদানের রাজধানী খার্তুম এবং আশপাশের অনেক শহরে আকস্মিক নাটকীয় এই পরিবর্তন ভয়াবহ রূপধারণ করেছে।
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি বলছে, এই সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু সুদানের দুই জেনারেল। একদিকে সেনাপ্রধান জেনারেল আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। আরেক দিকে আধা সামরিক বাহিনী র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেসের (আরএসএফ) প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হামদান দাগালো ওরফে হেমেদতি।
বিবদমান দুই পক্ষই একসময় মিত্র ছিল। দুই পক্ষ মিলে ২০২১ সালে এক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সুদানের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। এখন তাঁদের আধিপত্য বিস্তারের জেরে বাধা যুদ্ধে খণ্ডবিখণ্ড সুদান। দুই জেনারেলের সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। ২০০৩ সালে শুরু হওয়া সুদানের পশ্চিমাঞ্চলে গৃহযুদ্ধে দারফুরি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে পাল্টাপাল্টি ভূমিকায় দুজনই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন।
মাজাক ডি’আগুত সেই সময়ে সুদানের জাতীয় গোয়েন্দা ও নিরাপত্তা সংস্থার সহকারী পরিচালক ছিলেন। এরপর ২০১১ সালে বিচ্ছিন্ন হওয়ার সময় তিনি দক্ষিণ সুদানের উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়েছিলেন। ওই সময় তিনি দারফুরে জেনারেল বুরহান ও হেমেদতির সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তিনি তাঁদের বলেছিলেন, আপনারা একসঙ্গে ভালো কাজ করছেন। তবে তিনি বিবিসিকে বলেছেন, দেশের শীর্ষ ব্যক্তি হয়ে ওঠার সম্ভাবনা তাঁদের খুব কম।
মাজাক ডি’আগুত বলেন, ‘হেমেদতি কেবল একজন মিলিশিয়া নেতা ছিলেন। যিনি বিদ্রোহের সময় সরকারকে সাহায্য করতে গিয়ে বিদ্রোহী-বিরোধী ভূমিকা পালন করেছেন; সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করছেন। অন্যদিকে জেনারেল বুরহান একজন সৈনিক ছিলেন। যদিও সুদানি অফিসার কর্পসের সব উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে, সবকিছু সম্ভব ছিল।’
স্বাধীনতা-পরবর্তী ইতিহাসের বেশির ভাগ সময় ধরে সুদানের ক্ষমতায় ছিল সামরিক বাহিনী।
দারফুরে সরকারের কৌশলকে ‘সস্তায় বিদ্রোহ-বিরোধী’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন সুদানবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অ্যালেক্স দে ওয়াল। তিনি বলেন, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিয়মিত সেনা, জাতিগত মিলিশিয়া এবং বিমান হামলা চালানো হয়েছিল দারফুরে। সেখানে বেসামরিক নাগরিকদের হতাহতের বিষয়ে সামান্য কিছু বিবেচনা করা হয়নি।
শেষ পর্যন্ত কয়েক মাস বিক্ষোভের পর জেনারেল বুরহান ও হেমেদতি ২০১৯ সালের এপ্রিলে বশিরকে উৎখাত করতে একত্র হন। গণবিক্ষোভের জেরে ওই বছরের এপ্রিলে সুদানের প্রেসিডেন্ট আল-বশিরকে উৎখাত করে দেশটির সেনাবাহিনী। এর মধ্য দিয়ে তাঁর প্রায় ৩০ বছরের একনায়ক শাসনের অবসান ঘটে। তখন বুরহান ছিলেন সেনাবাহিনীর মহাপরিদর্শক। সে সময় সুদানের সবচেয়ে জ্যেষ্ঠ জেনারেলদের মধ্যে তাঁর অবস্থান ছিল তৃতীয়।
২০১৯ সালের মাঝামাঝি সময়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে একটা চুক্তি করে সেনাবাহিনী। চুক্তি অনুযায়ী গঠন করা হয় সার্বভৌম পর্ষদ (এসসি)। সামরিক-বেসামরিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গঠিত এই পর্ষদ। যার প্রধান ছিলেন জেনারেল বুরহান এবং বুরহানের সহকারী ছিলেন হেমেদতি।
এই পর্ষদ খুব বেশি দিন টেকেনি। বছর দু-একের মাথায় ২০২১ সালের অক্টোবরে বুরহানের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে বসে। ক্ষমতার শীর্ষে বসেন বুরহান। এবারও তাঁর সহকারী বনে যান হেমেদতি।
এসসির বেসামরিক সদস্য ছিলেন সিদিং তাওয়ার কাফি। তিনি নিয়মিত দুই জেনারেলের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতেন। ২০২১ সালের অভ্যুত্থান পর্যন্ত তিনি দুজনের মধ্যে কোনো মতবিরোধ দেখতে পাননি। বিবিসিকে তিনি বলেন, জেনারেল বুরহান ইসলামপন্থী এবং সাবেক কর্মকর্তাদের তাঁদের পুরোনো অবস্থানে ফিরিয়ে আনতে শুরু করেন। এটা স্পষ্ট হয়ে উঠছিল বুরহানের পরিকল্পনা ছিল ওমর আল-বশিরের পুরোনো শাসনকে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনা। হেমেদতি তখন সন্দেহ করতে শুরু করেন। তাঁর ধারণা ছিল, বশিরের কর্মকর্তারা তাঁকে পুরোপুরি বিশ্বাস করেনি।
গত দু-তিন বছর ধরে, হেমেদতি নিজেকে জাতীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে দাঁড় করানোর চেষ্টা করেছেন। এমনকি প্রান্তিক অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবেও দারফুর এবং দক্ষিণ কর্ডোফানের বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে জোট গঠনের চেষ্টা করছেন। অতীতে তাঁর বাহিনী নির্মমভাবে বেসামরিক বিক্ষোভকে দমন করা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তার কথা বলেছেন এই সময়ে।
এদিকে একটি বেসামরিক সরকার গঠনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সেনাবাহিনী এবং আরএসএফের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। কীভাবে আরএসএফকে নিয়মিত সশস্ত্র বাহিনীতে পুনরায় একীভূত করা উচিত তার জোর আলোচনা ওঠে। এর মধ্যেই শুরু হয় লড়াই। সুদানের নিয়ন্ত্রণের জন্য এসএএফের বিরুদ্ধে আরএসএফ, জেনারেল বুরহানের বিরুদ্ধে হেমেদতি।
তথ্য সূত্র: বিবিসি ও আল-জাজিরা
আরও পড়ুন: