ইন্দোনেশিয়ার একটি অস্থায়ী শিবিরে অবস্থান করছেন রোহিঙ্গা মোহাম্মদ রিদয়। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী—অপহরণ, চাঁদাবাজি এবং হত্যার হুমকি থেকে বাঁচতে বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়েছিলেন তিনি। পরে ১২ দিনের বিপজ্জনক এক সমুদ্রযাত্রা শেষে ইন্দোনেশিয়ার মাটিতে পা রেখেছেন।
২৭ বছর বয়সী রিদয় জানিয়েছেন, বর্তমানে তিনি ইন্দোনেশিয়ার পশ্চিম আচেহ প্রদেশের একটি অস্থায়ী শিবিরে ‘শান্তিপূর্ণ জীবন’ শুরু করছেন। শুধু মাত্র নভেম্বর মাসেই এই শিবিরে নতুন আরও সহস্রাধিক রোহিঙ্গা যোগ দিয়েছে। ২০১৫ সালের পর শিবিরটিতে এটাই সবচেয়ে বেশি সংখ্যায় রোহিঙ্গাদের আগমন।
রিদয় সহ শিবিরে বসবাস করা রোহিঙ্গারা দাবি করেছেন—তাঁদের সবাই বাংলাদেশের কক্সবাজার এবং আশপাশের ক্যাম্পগুলোতে ছিলেন। কিন্তু এই ক্যাম্পগুলোতে বর্বরতা সীমা ছাড়িয়েছে। মুক্তিপণ আদায়ের জন্য ক্যাম্পের বাসিন্দাদের প্রায় সময়ই অপহরণ করে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন গ্যাং। নির্যাতন সেখানে এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এসব ক্যাম্পে বর্তমানে ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছেন।
স্ত্রী, দুই সন্তান এবং এক ভাইকে নিয়ে পালানো রিদয় বলেন, ‘একটি দল আমাকে অপহরণ করেছিল এবং তাদের বন্দুক কেনার জন্য ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিল। বলেছিল, আমি যদি তাদের টাকা দিতে না পারি তবে তারা আমাকে মেরে ফেলবে।’
রিদয় জানান, শেষ পর্যন্ত ৩ লাখ টাকা দিয়ে তিনি ছাড়া পান এবং এক সপ্তাহের মধ্যেই পরিবারের সদস্যদের নিয়ে একটি নৌকায় চড়ে বসেন। গত ২১ নভেম্বর তিনি ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছান।
রিদয় বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশে নিরাপদ নই। সে কারণেই আমি আমার এবং আমার পরিবারের জীবন বাঁচাতে ইন্দোনেশিয়া আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম।’
২০১৭ সালে রাষ্ট্রীয় মদদে মিয়ানমারে নিপীড়নের শিকার হয়ে বাংলাদেশে পা রাখা রোহিঙ্গাদের অনেকেই এখন ১ হাজার ৮০০ কিলোমিটার সমুদ্র পথ পাড়ি দিয়ে ইন্দোনেশিয়ায় আশ্রয় নিতে চাইছে। ছোট ছোট নৌকায় যাত্রী বোঝাই হয়ে বিপদসংকুল এই পথ পাড়ি দিচ্ছে তারা।
এদিকে ইন্দোনেশিয়া জাতিসংঘের শরণার্থী কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী দেশ নয়। ফলে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আশ্রয় দিতে তারা বাধ্যও নয়। তারপরও অন্য কোনো দেশে সুযোগ না পেয়ে রোহিঙ্গারা ইন্দোনেশিয়ায় ঢুকে পড়ছে নিয়মিত।
গত ১৪ নভেম্বর থেকে রোহিঙ্গা বোঝাই হয়ে আধা ডজনের বেশি নৌকা ইন্দোনেশিয়ার আচেহ উপকূলে পৌঁছেছে। পর্যবেক্ষকেরা বলছেন—আরও বেশ কিছু নৌকা এখনো পথে রয়েছে। যদিও কিছু স্থানীয় মানুষ এ ধরনের নৌকাকে উপকূলে ভিড়তে না দিয়ে প্রায় সময়ই আবারও সমুদ্রের দিকে ঠেলে দেয়। এমনকি নৌকাগুলোকে ঠেকানোর জন্য তারা উপকূলে পাহারাও দেয়।
চলতি বছরের একটি প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে রাতের বেলায় ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায় কিছু অপরাধী চক্র এবং ইসলামপন্থী সশস্ত্র গোষ্ঠীর কথিত সহযোগীরা। এ ধরনের দুই ডজনের বেশি গ্যাং এখন ক্যাম্পগুলোতে সক্রিয় রয়েছে। এর মধ্যে অন্তত ১১টি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করেছে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়।
তবে অধিকার সংস্থাগুলো দাবি করছে, সহিংসতা থেকে উদ্বাস্তুদের রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশ যথেষ্ট কাজ করছে না। ফলে মাদক চোরাচালান ও মানব পাচারের মতো কর্মকাণ্ডে জড়িত সশস্ত্র ওই দলগুলো প্রায় সময়ই রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতা-কর্মীদের টার্গেট করছে।
রিদয় যে নৌকায় চড়ে ইন্দোনেশিয়ায় পৌঁছেছিলেন—একই নৌকায় দুই সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়েছিলেন ১৯ বছর বয়সী আয়েশা। একজন দোভাষীর সহযোগিতায় আয়েশা বলেন, ‘তারা প্রতি রাতে আমার স্বামীকে অপহরণের হুমকি দিয়ে টাকা চাইতো। আমি তাদের কারণে রাতে ঘুমাতে পারিনি।’
বাংলাদেশ পুলিশের তথ্য অনুযায়ী—চলতি বছর ক্যাম্পগুলোতে সহিংসতায় প্রায় ৬০ জন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে।
এইচআরডব্লিউ-এর এশিয়া বিষয়ক সহকারী পরিচালক ফিল রবার্টসন অভিযোগ করেছেন, বাংলাদেশ সরকার উদ্বাস্তুদের ভাগ্যকে ‘পাত্তা দেয় না’। মূল কথা হলো—বাংলাদেশ সরকার চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফিরে যাক।
আয়েশা জানান, অপরাধীদের ভয়ে ঝুঁকি সত্ত্বেও তার পরিবার ইন্দোনেশিয়ায় যাওয়ার জন্য দালালদের ২ লাখ টাকা দিয়েছিল।
শিবিরের চেয়ে বরং সমুদ্রে মৃত্যুকেই বেছে নিয়েছিলেন আয়েশা। তিনি বলেন, ‘আমি আমার বাচ্চাদের জন্য একটি নিরাপদ জায়গা খুঁজছিলাম, এই আশায় যে—তারা পড়াশোনা করবে, শিক্ষিত হবে।’