ফিলিস্তিনের দুর্দশার ইতিহাস কত দিনের? প্রায় ৭৪ বছরের। যদি দিনের হিসাব করতে যাই তবে তা আরও বেশি হবে। ৭৪ বছরেও কেন এই সংকটের কোনো সুরাহা হলো না তা নিয়ে বিস্তর আলাপ আলোচনা হয়েছে। কিন্তু, কোনো আলোচনাই কোনো সুরাহায় পৌঁছাতে পারেনি। ফিলিস্তিনেও আর শান্তি ফেরেনি। সর্বশেষ, গত শুক্রবার ভোরে ফজরের নামাজের পর আল আকসা মসজিদে ফিলিস্তিনিদের ওপর হামলা চালায় ইসরায়েলি পুলিশ।
এমন হামলা নতুন নয়। প্রতি বছর রমজান এলেই আল আকসায় এমন ঘটনা ঘটবেই। যদিও সর্বশেষ হামলার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো ইসরায়েলি পুলিশের বরাত দিয়ে বলছে, শুক্রবার ভোরে নামাজের পর শত শত ফিলিস্তিনি আল-আকসার নিকটবর্তী ইহুদিদের প্রার্থনাস্থান লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল, পাথর ছুড়তে শুরু করে। তারই জবাবে ইসরায়েলি পুলিশ ফিলিস্তিনিদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিপেটা, রাবার বুলেট ইত্যাদি ব্যবহার করে এবং এতে দেড় শতাধিক ফিলিস্তিনি আহত হন।
ফিলিস্তিনিদের ওপর এমন নির্যাতনের ঘটনা এই প্রথম নয়। বিগত ৭৪ বছর ধরেই চলছে এমনটা। আর ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বয়ানটাও কখনো বদলায় না। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো ইসরায়েলি বাহিনী ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে যেভাবে আচরণ করছে তাকে ‘জাতিবিদ্বেষ’ বলে আখ্যা দিয়েছে। কিন্তু এরপরও ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নির্যাতন–নিয়ন্ত্রণ বন্ধ হয়নি বরং ক্রমশ চেপে বসেছে।
ইসরায়েল এই চেপে বসার সাহস পেয়েছে দুই জায়গা থেকে। এক. ইসরায়েলের অভ্যন্তরের সমর্থন এবং দুই. আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন এবং নিষ্ক্রিয়তা। ইসরায়েলের সাধারণ জনগণ কখনো ফিলিস্তিনিদের দুঃখ বোঝার চেষ্টা করেছে কি না এবং করে থাকলে তার বহিঃপ্রকাশ কীভাবে হয়েছে তা নিয়ে কখনোই আলোচনা হয়নি।
তবে ইসরায়েলি দু-একটি মানবাধিকার সংস্থা যে একেবারে উদ্যোগ নেয়নি তা নয়। জেরুজালেমভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা বিটিসালেমের মতো বেশ কিছু সংগঠন ইসরায়েলের আগ্রাসন নিয়ে কথা বলেছে। কিন্তু এই সংখ্যা একেবারেই নগণ্য। কেবল মানবাধিকার সংস্থা নয় ইসরায়েলের গণমাধ্যমগুলোও নিরপেক্ষভাবে এই বিষয়ে অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছে।
তবে অল্প কিছু গণমাধ্যম আবার ইসরায়েলি অবস্থানের বিরুদ্ধেও অবস্থান নিয়েছে। গাজার ইউনিভার্সিটি অব উম্মাহর রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ও ইসরায়েল বিষয়ক গবেষক ড. আদনান আবু আমের লন্ডনভিত্তিক সংবাদমাধ্যম মিডল ইস্ট মনিটরে এক নিবন্ধে লিখেছেন, ‘ইসরায়েলি গণমাধ্যমগুলো ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার কভারেজের মাধ্যমে রাষ্ট্রকে (ইসরায়েলকে) ব্যর্থ বলে প্রমাণিত করেছে’।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি ইসরায়েলকে ফিলিস্তিনে ‘জাতিবিদ্বেষী’ কর্মকাণ্ড পরিচালনার সাহস জুগিয়েছে তা হলো, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা। বিশেষ করে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তা। যুক্তরাষ্ট্রের নিষ্ক্রিয়তাই ইসরায়েলকে এ পর্যন্ত বেড়ে ওঠার পথ দেখিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জেরুজালেমকে ইসরায়েলের রাজধানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং সেখানে তিনি নিজে উপস্থিত থেকে মার্কিন কনস্যুলেট উদ্বোধন করে এসেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের এমন উদ্যোগ যে ফিলিস্তিনকে আরও দুর্বল করে দেবে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। হয়তো এ প্রসঙ্গেই যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এ অ্যান্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের বুশ স্কুল অব গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পাবলিক সার্ভিসের ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এফ. গ্রেগরি গৌস আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিশ্লেষণ বিষয়ক সাময়িকী ফরেন অ্যাফেয়ার্সের এক নিবন্ধে বলেছেন, ‘ওয়াশিংটন এটা প্রমাণ করেছে যে—তারা একটি রাষ্ট্র গড়ার চেয়ে ভাঙতে পারে ভালোভাবে।’
ফলে প্রতিবছর মুসলমানদের পবিত্র মাস রমজান এলেই যে—ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের নির্যাতন তা মূলত ইসরায়েলের সেই ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা যা মূলত ফিলিস্তিনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতেই তৈরি করা হয়েছে। যার মাধ্যমেই ৭৪ বছর ধরে ফিলিস্তিন এবং ফিলিস্তিনিদের দমিয়ে রেখেছে। এই ব্যবস্থা ফিলিস্তিনকে সম্পূর্ণরূপে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাওয়ার জন্যই তৈরি হয়েছে। শুক্রবারের ঘটনা, প্রতি রমজানে ফিলিস্তিনিদের নির্যাতনের ঘটনা সেই ব্যবস্থার প্রয়োগ মাত্র।
বিশ্লেষণ সম্পর্কিত পড়ুন: