কোভিড মহামারিতে বিশ্বজুড়ে মারা যাওয়া মানুষের ২৮ শতাংশই লাতিন আমেরিকার। কেবল সাধারণ মানুষ নয়, চিকিৎসকের মৃত্যুর হারও এই অঞ্চলে বেশি। কেবল পেরুতেই মারা গিয়েছিলেন ৫৫১ জন। তবে কোভিড যখন অনেকটাই কমে এসেছে ঠিক তখনই লাতিন অঞ্চলে দেখা দিয়েছে বিদ্রোহ-ক্ষোভের আগুন। বিপন্ন হয়ে পড়েছে দেশগুলোর সরকার, রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনীতি। কিন্তু ফুটবলের অন্যতম পরাশক্তিগুলোর গোলবারে বিদ্রোহ-ক্ষোভের আগুন চোখ রাঙাচ্ছে কেন?
কী হচ্ছে লাতিন আমেরিকায়? না সবগুলো দেশে নয়, তবে অঞ্চলটির কয়েকটি দেশ বেশ সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যা ছড়িয়ে পড়তে পারে গোটা অঞ্চলে। এই যেমন, ইকুয়েডর, সেখানে জ্বালানি তেলে আরও ভর্তুকি, কর্মসংস্থান, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে আরও বরাদ্দের দাবিতে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ চলছে। পরিস্থিতি এরই মধ্যে বাজে আকার নিয়েছে। অনেকেই আশঙ্কা করছেন, এভাবে চলতে থাকলে ২০১৯ সালের মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। সে সময় শুধু বিক্ষোভের কারণে দেশটি ৯০ কোটি ডলার সমমূল্যের অর্থনৈতিক ক্ষতির শিকার হয়েছিল। একই অবস্থা জাইর বোলসোনারোর দেশ ব্রাজিলের। আসন্ন বিশ্বকাপ নিয়ে মাতামাতির বদলে সেখানে গুম ও খুন মাতামাতি হচ্ছে বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি। পেরুতে এই বিক্ষোভের কারণ হিসেবে এসেছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি।
শুরুটা হয়েছিল কোভিডের সময়ই। দেশগুলো, বিশেষ করে, পেরু, ব্রাজিল এবং ইকুয়েডরের মতো দেশে পর্যাপ্ত চিকিৎসা সেবার অভাবে অনেক রোগীকে সহায়-সম্বলহীনভাবে রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখা গেছে। যদিও কোভিড টিকা শুরুর পর লাতিনের দেশগুলো বেশ দ্রুতই জনগণকে টিকার আওতায় এনেছে। তদোসে পেল সাওদো নামে একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালিত জরিপ থেকে দেখা গেছে, লাতিনের দেশগুলোর প্রায় ৮৫ শতাংশ লোকজনকে টিকার আওতায় আনা হয়েছে। ব্রিটিশ সাময়িকী দ্য ইকোনমিস্ট অবশ্য ৮৫ শতাংশ বলছে না। তাদের প্রতিবেদনে এ হার ৭৫ শতাংশ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
২০১০-এর পরবর্তী বছরগুলোতে সেই ধারাবাহিকতায় বজায় থাকে। এই সময়ে অঞ্চলটি খুব একটা এগিয়েছে বলা যায় না। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে মূল্যস্ফীতি। ব্রাজিল, চিলি, আর্জেন্টিনা, ভেনেজুয়েলার মতো দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি হার প্রায় ১০ শতাংশের কাছাকাছি। দুঃসংবাদের বিষয় হলো—এই মূল্যস্ফীতি খুব দ্রুতই কমছে না। কারণ, বিশ্ব একটি যুদ্ধ দেখছে এখন, যেখানে অন্যতম পরাশক্তি রাশিয়া ও ইউরোপ সরাসরি জড়িত। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মকর্তা ইয়ান গোলফজান বলেছেন, ‘যুদ্ধের (ইউক্রেন যুদ্ধ) আগে হলে আমি বলতাম যে, আগামী দুই বছরের মধ্যে এটি সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিততে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।’
এখানেই শেষ নয়, মূল্যস্ফীতির সঙ্গে বিপরীত হারে কমেছে মজুরি। ফলে জীবনযাপন প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের ইকোনমিক কমিশন ফর ল্যাটিন আমেরিকা অ্যান্ড ক্যারিবিয়ান এক হিসাবে দেখিয়েছে, ২০২১ সালে লাতিন অঞ্চলে দারিদ্র্যের হার বেড়ে ৩২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। ২০১৫ সালে এটি ছিল ২৯ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা বলছে, লাতিনে মধ্যবিত্তের সংখ্যা বিপুল পরিমাণে কমে গেছে। ফলে, ওই অঞ্চলের মানুষদের পর্যাপ্ত খাদ্য না পাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
সব মিলিয়ে অঞ্চলটি উন্নয়ন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতার ফাঁদে পড়েছে। দ্য ইকোনমিস্ট বলছে, ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ তাদের তরুণ প্রজন্মের কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন আনতে যে পদক্ষেপ প্রয়োজন, তা নিতে সক্ষম নয়। ফলে সামাজিক ও রাজনৈতিক অসন্তোষ আরও বাড়ছে। ২০২১ সালে ইউএনডিপির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাতিনের জনগণের চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হওয়ায় ওই অঞ্চলে রাজনৈতিক-সামাজিক অস্থিরতা এবং বিভিন্ন ধরনের অপরাধ বাড়ছে। আর এমন পরিস্থিতিতে কোনোভাবেই কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। ফলে সংকট আরও দীর্ঘায়িত হতে যাচ্ছে বলেই ধারণা। এ প্রসঙ্গে চিলির সাবেক অর্থমন্ত্রী আন্দ্রেস ভালেসকো বলেছেন, ‘যখন আপনি উৎপাদন বাড়াতে, রাজনৈতিক অস্থিরতা কমাতে সামান্যতম আগ্রহ দেখাবেন না, তখন সেখান থেকে টেকসই উন্নয়ন বের করে আনা সম্ভব নয়।’
আশার কথা এই যে, মাত্রার তারতম্য থাকলেও এই অঞ্চলের দেশগুলোতে এখনো গণতন্ত্রের চর্চা বজায় রয়েছে। কিন্তু বিশ্বে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের ধারক–বাহক বলে খ্যাত পশ্চিমা বিশ্ব লাতিনের এই সংকটে কতটা এগিয়ে আসবে তাই এখন বিবেচ্য। বিশেষ করে, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যেখানে বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি ক্রমশ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যের মতো দেশগুলোও নিজ নিজ ইতিহাসে সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতির মুখোমুখি। ফলে, পরিবর্তিত বৈশ্বিক ভূ–রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে লাতিনের দেশগুলো কীভাবে তাদের গোলবার থেকে অর্থনৈতিক–রাজনৈতিক–সামাজিক সংকটের বল সরাবে তাই এখন দেখার বিষয়।
সূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, রয়টার্স, ইউএনডিপি, বিবিসি