স্বপ্নের পদ্মা সেতুর বদৌলতে রাজধানী ঢাকার সঙ্গে বিভিন্ন জেলার সহজ যোগাযোগ নিঃসন্দেহে অর্থনীতির চাকা বেগবান করবে। এই সেতু ঘিরে এখন নতুন করে স্বপ্ন দেখছে ওই পারের মানুষ। সুখের দিনে ভোগান্তির সময়ের স্মৃতিচারণ করে পদ্মার ওই পারের নারী কর্মীরা স্বপ্ন দেখছেন অন্য এক ভবিষ্যতের।
পদ্মা নদীর পাড়ে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে করতে মমতাজ বেগম কত ঘণ্টা ব্যয় করেছেন, তার সঠিক হিসাব নেই। জন্মস্থান ফরিদপুর থেকে রাজধানী ঢাকায় যেতে আগে দিন পার হয়ে যেত তাঁর। এই যাত্রা ছিল বিপজ্জনকও। গত বছর, নৌকার ওপর এক ব্যক্তিকে হিট স্ট্রোকে মারা যেতে দেখেছেন তিনি। অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাইয়ের কারণে ফেরি উল্টে পানিতে ডুবে মারা গেছেন মমতাজের এক ভাই। বাস ও নৌকায় চলাচল করতে গিয়ে ‘ভয়াবহ হয়রানির’ শিকার হয়েছেন ৩৩ বছর বয়সী এ পোশাকশ্রমিক। এত পথ একা চলাচল করায় প্রতিবেশীদের কটু কথারও শিকার হতেন মমতাজ।
কয়েক দশক আগে বাংলাদেশের অর্থনীতি গতিশীল হওয়া শুরু করলে ভাগ্য বদলের আশায় রাজধানী ঢাকায় ছুটতে শুরু করেন লাখো মানুষ, যাদের একটি বড় অংশই নারী। বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পে কর্মরত ৪০ লাখ শ্রমিকের প্রায় ৮০ শতাংশই নারী। তাঁদের হাত ধরে সামনের দিকে চালিত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
সাড়ে তিন শ কোটি ডলারের বেশি ব্যয়ে নির্মিত পদ্মা সেতু বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের অন্তত তিন কোটি মানুষের সরাসরি উপকার করবে। মূলত পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে চাকরি ও ব্যবসার প্রসার ঘটাবে। বিশেষ করে নারীদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের এক নতুন দুয়ার উন্মোচন করবে এই সেতু। যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদ ড. মুশফিক মোবারক বলেন, ‘এ ধরনের প্রকল্পগুলো সবারই উপকার করে। তবে বেশি উপকারে আসে নারীদের, যাদের ভ্রমণ রক্ষণশীল দক্ষিণ এশীয় সমাজে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে। দূরত্ব যত বেশি, কাজে বাধাও তত বেশি।’
পদ্মা সেতু থেকে নারীদের কী লাভ হতে পারে, তা পূর্বের একটি প্রকল্প নিয়ে করা নতুন গবেষণায় উঠে এসেছে। ১৯৯৮ সালে যমুনা সেতু চালু হলে বাংলাদেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার সংযোগ ঘটে। এতে রাজধানীর সঙ্গে ওই অঞ্চলের মানুষের যাতায়াত সময় অনেকটা কমে যায়। ওই অঞ্চলের যে শহরের বাসিন্দার আগে ১২ থেকে ৩৬ ঘণ্টা লাগত গন্তব্যে পৌঁছাতে, তা চার ঘণ্টায় নেমে আসে।
এ ধরনের নিয়মকানুন প্রায়ই নারীদের একা ভ্রমণে বাধা দেয়। অবিবাহিত বা সঙ্গীহীন নারীদের অভিবাসনের সংখ্যা বাড়েনি। তবে পরিবারগুলো তাদের মেয়েদের ঢাকায় বসবাসরত পুরুষদের সঙ্গে বিয়ে দিতে আগ্রহী হয়েছে। দূরের শহরটি কাছাকাছি চলে এসেছে বলে মনে করছে তারা। পরে এসব নারীর অনেকেই পোশাক কারখানায় কাজ নিচ্ছেন।
গবেষণা প্রতিবেদনটির আরেক লেখক নিয়াজ আসাদুল্লাহ বলেন, কর্মজীবী পুরুষেরা নিঃস্বার্থভাবে নারীদের শহরে নিয়ে যাচ্ছে—এমন নয়। সেতুটি নির্মিত হওয়ার পর শহরে থাকা পাত্ররা যৌতুক নেওয়ার পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়। অনেক নারী বা তাদের পরিবার মোটা অঙ্কের যৌতুকের বিনিময়ে রাজধানীতে বসবাস করা পাত্র খোঁজেন।
অর্থনীতিবিদ ড. মোবারকের আরেক গবেষণায় দেখা যায়, যেসব গ্রামের নারীরা গার্মেন্টসে গিয়ে একদিনের মধ্যে ফিরতে পারেন, সেখানকার বাবা-মায়েরা তাদের মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে বেশি আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে তাদের লক্ষ্য—মেয়েদের জন্য পাত্র জোগাড় নয়, বরং চাকরি নিশ্চিত করা।
স্বপ্নের পদ্মা সেতু সম্পর্কে সবশেষ খবর পেতে - এখানে ক্লিক করুন
ভারত ও পাকিস্তানে শ্রমিকদের মধ্যে মাত্র ২০ শতাংশ নারী। আর বাংলাদেশে এ সংখ্যা ৩৬ শতাংশ। ড. মোবারক বলেন, ‘আপনি যদি অর্ধেক জনসংখ্যাকে উৎপাদনশীল করতে না পারেন, তাহলে তা সর্বদা প্রবৃদ্ধির পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। সব দেশের সরকারই সেতুর মতো স্থাপনা পছন্দ করে। তবে দক্ষিণ এশিয়ায় এ ধরনের উদ্যোগ নারীদের উপকৃত হওয়ার বাড়তি সুযোগ বয়ে আনে।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে অনুবাদ করেছেন তামান্না-ই-জাহান
পদ্মা সেতু সম্পর্কিত আরও পড়ুন: