অনেক তো হলো। এবার কৃষকেরাই চোখ রাঙাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদিকে। লক্ষ্য সামনের বিধানসভা নির্বাচন। এই চোখ রাঙানিতে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ পড়েছে বিজেপি নেতাদের কপালেও।
আগামী বছরের শুরুতেই উত্তর প্রদেশসহ ভারতের পাঁচ রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। আর ২০২৪ সালে তো লোকসভা নির্বাচন আছেই। ফলে কৃষকদের এই আন্দোলন বেশ ভাবাচ্ছে ভারতের সরকারকে। কারণ এরই মধ্যে কৃষক আন্দোলনের নেতা রাকেশ টিকায়েত ঘোষণা দিয়েছেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিই এখন তাঁদের প্রচারের মূল বিষয়। দেশজুড়ে আন্দোলনে মোদিই হবেন তাঁদের নিশানা। নিঃসন্দেহে এই ঘোষণায় কপালে ভাঁজ পড়ার কথা মোদির। পড়েছেও। আজ মঙ্গলবারও কৃষক আন্দোলনে উত্তাল ভারতের হরিয়ানা রাজ্য। গত ২৮ আগস্ট পুলিশের লাঠি চার্জের প্রতিবাদে মঙ্গলবার কারনলে গণসমাবেশের ডাক দিয়েছিল সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। কিন্তু অনুমতি দেয়নি প্রশাসন। ফলে সকাল থেকেই উত্তেজনা তুঙ্গে। বিনা অনুমতিতেই কৃষকেরা মিছিল করতে চাইলে পুলিশ বাধা দেয়। তবে গত ২৮ আগস্টের মতো লাঠি চার্জের মতো ভুল এবার করেনি। যদিও নিরাপত্তার অজুহাতে বন্ধ রাখা হয় ইন্টারনেট ও এসএমএস পরিষেবা। বহিরাগতদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। কিন্তু এত কিছুর পরও জনসমুদ্রে রূপ নেয় কারনল।
মোদি সরকারের তিনটি কৃষি আইন নিয়ে ফের বেগবান হচ্ছে কৃষক আন্দোলন। এই আন্দোলনকে এরই মধ্যে সমর্থন জানিয়েছে কংগ্রেস, সিপিএমসহ বিজেপিবিরোধী জোটগুলো। এমনকি বিজেপি সাংসদ বরুণ গান্ধীও সহানুভুতি জানিয়েছেন কৃষক আন্দোলনে প্রতি। গত বছর থেকে শুরু হওয়া এই আন্দোলন মাঝে করোনার কারণে কিছুটা স্তিমিত হয়ে এলেও এখনো যথেষ্ট আগুন জিইয়ে রেখেছে। কৃষিকে কৃষকের হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে করপোরেট কৃষিতে রূপান্তরের চেষ্টা হিসেবে নতুন আইনগুলোকে দেখছেন কৃষকেরা।
এই তিন আইনে কী রয়েছে? প্রথমত, এই আইনের ফলে সরকার নিয়ন্ত্রিত পাইকারি কৃষিবাজার বা মান্ডিগুলো কার্যত অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যাবে। আরেকটি আইনের কারণে পূর্বনির্ধারিত দাবে চুক্তিভিত্তিক চাষ উৎসাহিত হবে। আর অন্য আইনটি মুখ্যত মজুতদারির সীমানাই তুলে দেবে। ফলে সাধারণ কৃষক এই তিন আইনকেই তাদের শত্রু হিসেবে গণ্য করছেন। তাঁরা একে নিজেদের মৃত্যু হিসেবে বিবেচনা করছেন। শুরু থেকেই এ আইনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান কৃষকেরা। গত বছরের এই সময়ে গোটা ভারত কৃষক আন্দোলনে উত্তাল হয়ে ওঠে। মাঝে কিছুটা স্তিমিত হলেও এখন আবার বিশেষত হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ, দিল্লি ইত্যাদি রাজ্যে কৃষক আন্দোলন বেশ জোরদার হয়েছে।
গত রোববার উত্তর প্রদেশের মুজফফরনগরে আয়োজন করা হয়েছিল মহাপঞ্চায়েতের (গণসমাবেশ)। ১৫টি রাজ্য থেকে ৩০০টিরও বেশি কৃষক সংগঠনের সদস্যরা অংশ নেন সেখানে। জমায়েতও হয়েছিল চোখে পড়ার মতো। এই গণমাবেশ থেকেই আগামী ২৭ সেপ্টম্বর ‘ভারত বন্ধ’-এর ডাক দেওয়া হয়। শুধু তাই নয়, ঘোষণা করা হয় ৯ ও ১০ সেপ্টেম্বর লক্ষ্ণৌতে হবে আরও একটি কৃষক সমাবেশ। আর উত্তর প্রদেশের প্রতিটি জেলাতেই কৃষক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে। আগামী বছরের বিধানসভা নির্বাচন ও ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনকে লক্ষ্য করে এই সমাবেশগুলো থেকে ‘নো ভোট ফর বিজেপি’ আওয়াজ তোলা হবে। সঙ্গে চলবে দিল্লিতে আন্দোলন।
কৃষি আইন সংস্কারের দাবিতে গত বছরের নভেম্বরে শুরু হয় দিল্লিতে ধর্ণা। টিকায়েতদের ঘোষণা, কৃষি আইন বাতিল না করা হলে তাঁরা দিল্লির সীমানা ছাড়বেন না। বরং আরও বাড়বে আন্দোলনের তীব্রতা। সেই সঙ্গে ‘মিশন উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাখণ্ড’-এর ঘোষণাও দিয়েছেন তিনি। এই মিশনের লক্ষ্য হলো বিজেপি শাসিত রাজ্য দুটিতে অ-বিজেপি সরকার গঠন। সেই লক্ষ্যে প্রতিটি জেলাতেই মহাপঞ্চায়েত গড়ে তুলবেন তাঁরা। মোদির লোকসভা কেন্দ্র বারানসিতেও মহাপঞ্চায়েত হবে বলে ঘোষণা এসেছে।
রাকেশ টিকায়েতদের যেখানে শক্তি, সেখানেই দুর্বলতা মোদি সরকারের। সরকার যে এই প্রশ্নে ৎদুর্বল অবস্থানে আছে, তার প্রমাণ এরই মধ্যে পাওয়া গেছে। কারনলে গত ২৮ আগস্ট সরকারি কর্মকর্তা পুলিশকে আন্দোলনকারীদের মাথা ফাটিয়ে দেওয়ার হুকুম দিয়েছিলেন। এই হুকুম একজন ভিতু কর্মকর্তাই কেবল করতে পারেন। কিংবা আজ হরিয়ানার গণসমাবেশের প্রেক্ষাপটে সেখানকার মানুষের চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির যে চেষ্টা, মোবাইল নেটওয়ার্ক বা এসএমএস পরিষেবা বন্ধ করার যে পদক্ষেপ, কিংবা দিল্লি সীমান্তে কৃষকদের অবরোধের কারণে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তির যে আন্দোলন-বিরোধী মামলা এবং ওই ব্যক্তির দলীয় পরিচয় ইত্যাদি সবকিছুই বলছে নরেন্দ্র মোদি সরকার বেশ ঘাবড়ে গেছে।
মোদি সরকার হয়তো কখনো ভাবেইনি, টানা দশ মাস একটি আন্দোলন চলতে পারে। তারা হয়তো ভেবেছিল কোভিডের ধাক্কায় জীবন-জীবিকার প্রসঙ্গটি কৃষকদের ভুলিয়ে দেওয়া গেছে। কিন্তু কৃষকেরা জানিয়ে দিলেন, তাঁরা ভোলেননি। বরং আরও সংগঠিত হয়ে তাঁরা ফিরে এসেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা বড় বড় বুলি আওড়ানো মোদি বিরোধী তথাকথিত রাজনৈতিক নেতাদেরও জানিয়ে দিয়েছেন—আন্দোলন করতে হয় ভেতরের শক্তি দিয়ে। অন্যের ঘাড়ে পা দিয়ে, ফাঁকা বুলি দিয়ে শুধু ক্ষমতার লক্ষ্যে এত দীর্ঘ আন্দোলন করা আসলে যায় না।
আর বিজেপি কী দেখছে? তারা দেখছে চির পরিচিত সেই ‘বিদেশি মদদ’। তারা এতে ‘ষড়যন্ত্র’ খুঁজে পাচ্ছে। যেনতেন নয়, বিশাল ষড়যন্ত্র। যেকোনো কর্তৃত্বপরায়ণ প্রশাসনের মতো করেই তারা ভাবছে, এগুলোকে গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই। কিন্তু নির্বাচনের আগে আগে এই কৃষক সমাবেশগুলো প্রতিহতে তাঁরা যা করছেন, তা বলে দিচ্ছে—এর চেয়ে বেশি গুরুত্ব সম্ভবত কোনো সমাবেশকে শান্তিপূর্ণভাবে দেওয়া যায় না।