ইউক্রেনে রাশিয়ার আগ্রাসন কবে শেষ হবে তা কেউ জানে না; কীভাবে শেষ হবে তা-ও অজানা। তবে প্রায় এক বছরের লড়াইয়ের পর অন্তত পাঁচটি বিষয় এখন ইউক্রেনের সামনে স্পষ্ট। এই পাঁচটি বিষয়ের আলোকে বলা যায়, ২০২৩ সাল ইউক্রেনকে ঘুরে দাঁড়ানোর অনেক সুযোগ দেবে।
প্রথমত, যুদ্ধের ময়দানে ইউক্রেন এখনো টেকসই অবস্থানে আছে। তারা এখনো দৃঢ়চিত্ত ও অনমনীয়। অন্যদিকে রাশিয়া এখনো চেষ্টা করে যাচ্ছে ইউক্রেনের অবকাঠামো ধ্বংস এবং ইউক্রেনকে একটি অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করতে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের চারটি অঞ্চল নিজের দখলে নিয়েছেন বটে, তবে সেগুলো ধরে রাখা তাঁর জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। এর জন্য তাঁর সেনাবাহিনীকে আরও প্রশিক্ষণ দিতে হবে এবং অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করতে হবে। কিন্তু পুতিনের জন্য একটি বড় শিরপীড়া হচ্ছে, রাশিয়ার সিংহভাগ নাগরিক এই যুদ্ধের বিপক্ষে। ফলে রাশানদের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনি যদি যুদ্ধ চালিয়ে যান, তবে যত বেশি সেনা মরবে, তত বেশি তাঁকে নিজ দেশের মানুষের কাছে জবাবদিহির মুখোমুখি হতে হবে। অবশ্য জবাবদিহির মুখোমুখি হওয়াকে থোড়াই কেয়ার করেন পুতিন।
ইউক্রেনের চিত্রটা ঠিক এর বিপরীত। সেখানে সৈন্যরা অনমনীয় এবং দেশকে রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি কৌশলী ও বুদ্ধিমান সেনা কর্মকর্তাদের একত্রিত করছেন। এ ছাড়া জেলেনস্কি যে সুবিধাটা পাচ্ছেন, সেটি হচ্ছে, সামরিক জোট ন্যাটোভুক্ত দেশগুলো ইউক্রেনকে অস্ত্র সরবরাহ করছে এবং বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছে। ইতিমধ্যে ইউক্রেনের দক্ষিণে দনবাস অঞ্চলে রুশ বাহিনীকে হটিয়ে দিয়েছে তারা। এ ছাড়া পূর্বাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলে রুশ হামলায় বন্ধ হয়ে যাওয়া বিদ্যুতের ব্যবস্থাও পুনরুদ্ধার করেছে ইউক্রেন। ইউক্রেন যোদ্ধাদের অগ্রগতি আপাতত ধীরগতির মনে হলেও তারা কিন্তু থেমে নেই।
পুতিনের এসব হুমকি দিন শেষে বুমেরাং হয়েছে। তিনি ‘হাস্যকর’ ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। ইউক্রেন-রাশিয়ার আজকের এই সংঘাতের বীজ লুকিয়ে আছে ২০১৪ সালে। ওই বছর প্রথম ইউক্রেনে হামলা চালিয়ে সংঘাতের বীজ বপন করেছিলেন পুতিন।
যা হোক, অবস্থা এখন এমন দাঁড়িয়েছে, পশ্চিমা অস্ত্রগুলো পূর্বদিকে আসতেই থাকবে আর রাশিয়ার গ্যাস কখনোই আগের মতো পশ্চিমে যাবে না। ফলে এই শীতকাল পাড়ি দেওয়া ইউরোপের জন্য কঠিন হবে।
তৃতীয়ত, চীন এই যুদ্ধে রাশিয়াকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। তবে ভারত ও অন্যান্য অনেক উন্নয়নশীল দেশ রাশিয়ার দিক থেকে ধীরে ধীরে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ অবস্থায় পুতিন এখানেও সমর্থন হারাচ্ছেন। গত সেপ্টেম্বরে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের শীর্ষ সম্মেলনে পুতিন তাঁর সমমনা নেতাদের কাছ থেকে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছিলেন বটে, তবে অক্টোবরেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ভোটে তিনি আক্রমণের স্বীকার হয়েছেন।
চতুর্থত, যুদ্ধ শেষ করার জন্য পুতিনের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ছে। বিশ্বের ধনী দেশগুলোর ক্লাব হিসেবে পরিচিত ওইসিডি (অর্গানাইজেশন ফর ইকোনমিক কো-অপারেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) বলেছে, যুদ্ধ বাবদ ২০২৩ সালে ২ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমারা যেভাবে ইউক্রেনকে অস্ত্র পাঠাচ্ছে, তাতে তাদের অস্ত্রভান্ডারে ঘাটতি দেখা দেবে। এটি একটি উদ্বেগের বিষয়। ফলে ধারণা করা যায়, যুদ্ধ বন্ধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য এ বছর প্রচুর আলোচনা হবে।
কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন—কারও মধ্যে এখনো অস্ত্রবিরতিতে যাওয়ার কোনো লক্ষণ নেই। পুতিন যেন বাজি ধরেছেন, তিনি আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে যুদ্ধ চালিয়েই যাবেন। অন্যদিকে জেলেনস্কিও বারবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যাচ্ছেন, তিনি ২০১৪ সাল থেকে ইউক্রেনের যেসব ভূখণ্ড বেহাত হয়েছে, সেসব পুনরুদ্ধার না করা পর্যন্ত যুদ্ধের মাঠ ছাড়বেন না।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, পশ্চিমারা এখন বলছে, শান্তি আলোচনার জন্য ইউক্রেনকে একাই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আবার যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তারা ইউক্রেনকে অস্ত্র, অর্থও সরবরাহ করে যাচ্ছে।
পুতিন শেষ মুহূর্তে মারিয়া হয়ে রাসায়নিক অস্ত্র বা পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারেন। তাতে তাঁর বিজয়ের পথ সুগম হবে এমনটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে ইউক্রেনের জন্য আশার কথা হচ্ছে, ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকার জন্য পুতিন তাঁর যুদ্ধ ব্যয় কমাতে চাইবেন।
অন্যদিকে পুতিন হয়তো ভাবছেন, নতুন বছরে যুদ্ধের গতি পরিবর্তিত হবে, চীনের সামরিক সহায়তা বাড়বে, ইউরোপীয় ঐক্যে ফাটল ধরবে, তারা ইউক্রেনের সঙ্গ ত্যাগ করবে এবং যুক্তরাষ্ট্রে পুনরায় ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্ষমতায় আসবেন। কারণ যুদ্ধে সবকিছুই সম্ভব। তবে পুতিনকে এটাও মনে রাখতে হবে, আপাতত জোয়ার তাঁর বিরুদ্ধে।
তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: মারুফ ইসলাম