হোম > বিশ্লেষণ

ডিপসিক এআই: তুরুপের তাস নাকি শুধুই বুদ্‌বুদ

অনলাইন ডেস্ক

ডিপসিক আসলে কতটা কার্যকর তা নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের অনেকেই প্রশ্ন তুলেছেন। ছবি: সংগৃহীত

চীনা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) উদ্যোগ ডিপসিক গুগল ও ওপেনএআইয়ের তৈরি মডেলের প্রতিদ্বন্দ্বী সক্ষমতাসম্পন্ন একটি এআই মডেল উন্মোচন করেছে। উন্মোচনের কয়েক দিনের মধ্যেই এর প্রভাবে মার্কিন শেয়ারবাজারে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর শেয়ারে ধস নেমেছে। তবে এই মুহূর্তে যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি ঘুরপাক খাচ্ছে সেটি হলো—চীনের ডিপসিক যেসব দাবি করেছে তা আসলে কতটা বাস্তবসম্মত।

হাংঝৌভিত্তিক এই স্টার্টআপ বা উদ্যোগটি দাবি করেছে, তারা ডিপসিক আর১ মডেলটি সিলিকন ভ্যালির সাম্প্রতিকতম মডেলগুলোর তুলনায় অনেক কম খরচে তৈরি করেছে। এই ঘোষণা এআই দুনিয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রাধান্য ও শীর্ষ প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর বিপুল বাজারমূল্য সম্পর্কে প্রচলিত ধারণাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

তবে কিছু সংশয়বাদী ডিপসিকের সীমিত বাজেটে কাজ করার দাবিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন। তাঁদের ধারণা, প্রতিষ্ঠানটি সম্ভবত প্রকাশিত তথ্যের চেয়ে বেশি উন্নত চিপ ও বেশি পরিমাণ তহবিলের সুবিধা পেয়েছে। যেমন ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশলের অধ্যাপক এমেরিটাস পেদ্রো দোমিঙ্গোস আল জাজিরাকে বলেছেন, ‘ডিপসিকের দাবিগুলোকে সরাসরি বিশ্বাস করা যায় কি না, তা এখনো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। এআই কমিউনিটি এটি গভীরভাবে বিশ্লেষণ করবে এবং আমরা সেটির সত্যতা জানতে পারব।’

তবে মার্কিন এই গবেষক বলেন, ‘তাঁদের পক্ষে ৬ মিলিয়ন ডলারে একটি (এআই) মডেল প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব বলেই আমার কাছে বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়। একই সঙ্গে এটাও সম্ভব যে মডেলটির ফাইন-টিউনিং ও মডেলটি তৈরি হওয়ার পর সেটিকে পলিশ করার খরচ হয়তো এই অর্থ। প্রকৃতপক্ষে এই মডেলের মৌলিক কাঠামো তৈরিতে আরও বেশি ব্যয় হয়েছে। ডিপসিক হয়তো নিজেরা এই ব্যয় করেনি বরং অন্যদের ব্যয়বহুল মডেলের ওপর ভিত্তি করেই এটি তৈরি করেছে।’

গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে ডিপসিক ডেভেলপমেন্ট টিম জানিয়েছে, তারা ২ হাজারটি এনভিডিয়া এইচ ৮০০ জিপিইউ এনেছে। এই চিপটি অন্যান্য চিপের তুলনায় একটু কম উন্নত এবং মূলত যুক্তরাষ্ট্রের রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজাইন করা হয়েছিল। গবেষণাপত্রে এই দাবিও করা হয়, ডিপসিকের আর১ মডেল এবং এর ভিত্তি মডেল ভি-৩-এর প্রশিক্ষণে ৫ দশমিক ৬ মিলিয়ন ডলার তৈরি হয়েছে।

অথচ, ওপেনএআইয়ের চ্যাটবট চ্যাটজিপিটির প্রশিক্ষণে খরচ হয়েছিল এর চেয়ে কয়েক গুণ বেশি। ওপেনএআইয়ের সিইও স্যাম অল্টম্যান বলেছেন, জিপিটি-৪ চ্যাটবটের প্রশিক্ষণে ১০০ মিলিয়নেরও বেশি খরচ হয়েছে। আবার একই সময়ে বিশ্লেষকরা ধারণা করেছেন, জিপিটি-৪ অন্তত ২৫ হাজারটি অনেক বেশি উন্নত এইচ ১০০ জিপিইউ ব্যবহার করেছে।

লিয়াং ওয়েনফেং নামে এক চীনা উদ্যোক্তা ২০২৩ সালের শেষ দিকে প্রতিষ্ঠা করেন ডিপসিক। তাঁর হাত ধরে ডিপসিকের যাত্রা শুরু এআই দুনিয়ায় সেরা অবস্থানে থাকার জন্য কোম্পানিগুলোর বিশাল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ এবং উচ্চ মূল্যের চিপের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কিত প্রচলিত ধারণা ভেঙে দিয়েছে।

ডিপসিকের উত্থান ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে চীনের এআই খাতকে দমনের প্রচেষ্টার কার্যকারিতা সম্পর্কে প্রশ্ন তোলার পাশাপাশি চীনের সবচেয়ে উন্নত চিপের রপ্তানি নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্তকেও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ক্যালিফোর্নিয়াভিত্তিক চিপ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান এনভিডিয়ার শেয়ার গত সোমবার ১৭ শতাংশ কমে যায় এবং এতে কোম্পানিটি প্রায় ৫৯৩ বিলিয়ন ডলার বাজারমূল্য হারায়, যা সুইডেনের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) সমান।

যদিও ব্যাপক মতামত রয়েছে যে, ডিপসিকের আর১ ভার্সনের আত্মপ্রকাশ একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন, তবে বিশিষ্ট পর্যবেক্ষকেরা প্রতিষ্ঠানটির দাবিকে যাচাই-বাছাই না করে গ্রহণ করার জন্য সতর্ক করেছেন। ভার্চুয়াল রিয়্যালিটি বিষয়ক কোম্পানি অকুলাস ভিআরের প্রতিষ্ঠাতা পলমার লাকি ডিপসিকের দাবি করা বাজেটকে ‘ভুয়া’ বলে আখ্যায়িত করে বলেছেন, অনেক ‘নির্বোধ পাগল’ চীনের প্রচারণার ফাঁদে পড়েছে।

লাকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে শেয়ার করা এক পোস্টে বলেন, এটি চীনা হেজ ফান্ড পরিচালিত একটি উদ্যোগ এবং এটি করা হচ্ছে আমেরিকান এআই স্টার্টআপে বিনিয়োগ কমানোর জন্য। এ ছাড়া, এনভিডিয়ার মতো আমেরিকান জায়ান্টদের বিরুদ্ধে তাদের অক্ষমতা ঢাকতে এবং নিষেধাজ্ঞা এড়াতেই এটি করা হচ্ছে। তিনি আরও দাবি করেন, ‘আমেরিকা এমন একটি উর্বর ক্ষেত্র যেখানে মনস্তাত্ত্বিক কার্যক্রম ব্যাপকভাবে ঘটছে। কারণ, আমাদের গণমাধ্যম আমাদের প্রযুক্তি কোম্পানিগুলির বিরুদ্ধে এবং প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের পরাজয় দেখতে চায়।’

গত সপ্তাহে মার্কিন সম্প্রচারমাধ্যম সিএনবিসির এক সাক্ষাৎকারে স্কেল-এআইয়ের সিইও আলেক্সান্ডার ওয়াং ডিপসিকের বক্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেন, তিনি নিশ্চিত যে ডিপসিকের কাছে ৫০ হাজার উন্নত এইচ ১০০ চিপ ছিল। কিন্তু মার্কিন রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে তারা বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করতে পারছিল না।

ওয়াং অবশ্য তাঁর দাবির পক্ষে কোনো প্রমাণ দেননি। ডিপসিকের কাছে বিষয়টি জানতে চাওয়া হলেও তারা এই বিষয়ে মন্তব্য করেনি। এদিকে টেক বিলিয়নিয়ার ইলন মাস্ক ডিপসিকের সমালোচকদের সমর্থন জানিয়েছেন। তিনি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে আলেক্সান্ডার ওয়াংয়ের দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করে তাঁর পোস্টের নিচে ‘অবশ্যই’ লিখেন।

ডিপসিকের আগের একটি মডেলে কাজ করা পিএইচডি শিক্ষার্থী জিহান ওয়াং স্টার্টআপটির সমালোচকদের জবাব দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘বলার চেয়ে করে দেখানো ভালো।’ তিনি বলেন, সমালোচনা করা সহজ। যদি তারা কোডের ওপর বেশি সময় ব্যয় করে ডিপসিকের আইডিয়া পুনরুৎপাদন করতে চেষ্টা করত, তাহলে সেটা কথা বলার চেয়ে অনেক ভালো হতো।

তবে ডিপসিক আসলেই মাত্র ৬০ লাখ ডলার ব্যয় করে এবং তুলনামূলক কম উন্নত চিপ ব্যবহার করে তাদের আর১ মডেল প্রশিক্ষণ দিতে পেরেছে কি না—এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর দেননি ওয়াং। এর আগে, ২০২৩ সালে চীনা গণমাধ্যম ওয়েভসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে লিয়াং ওয়েনফেং বলেছিলেন, তাঁর কোম্পানি এনভিডিয়ার ১০ হাজার এ১০০ চিপ মজুত করেছে। এই চিপ এনভিডিয়ার এইচ ৮০০-এর চেয়ে বেশ পুরোনো। এর পরপরই তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এগুলোর রপ্তানি নিষিদ্ধ করেন।

চীনে তৈরি হওয়ার কারণে, বিশেষজ্ঞ এবং ব্যবহারকারীরা ডিপসিকের আর১ ভার্সনের কিছু সীমাবদ্ধতার দিকে ইঙ্গিত করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো বেইজিংয়ের দৃষ্টিতে স্পর্শকাতর বিষয়গুলোর সেন্সরশিপ। যেমন, ডিপসিকের কাছে ১৯৮৯ সালের তিয়ানআনমেন স্কয়ার গণহত্যা এবং তাইওয়ানের রাজনৈতিক অবস্থান বিষয়ে কোনো তথ্য পাওয়া যাবে না।

ডিপসিকের কারণে মার্কিন প্রযুক্তি খাতের ওপর সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে শুরুতে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছিল, তার তীব্রতা কমতে শুরু করার ইঙ্গিত হিসেবে গতকাল মঙ্গলবার এনভিডিয়ার শেয়ারের মূল্য প্রায় ৯ শতাংশ বেড়েছে আবার। প্রযুক্তিপ্রতিষ্ঠানকেন্দ্রিক পুঁজিবাজার নাসদাক-১০০ সূচক ১ দশমিক ৫৯ শতাংশ বেড়েছে। অথচ, আগের দিন এর সূচক ৩ শতাংশের বেশি নেমে গিয়েছিল।

কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাবিষয়ক অধ্যাপক টিম মিলার বলেছেন, ‘ডিপসিকের দাবিকে কতটা বিশ্বাসযোগ্য মনে করা উচিত, তা বলা কঠিন। সাধারণত মডেল নিজেই এর কাজ করার কিছু বিবরণ প্রকাশ করে। তবে ডিপসিক যে বড় পরিবর্তনের দাবি করছে, যতটা আমি বুঝেছি তা আসলে এর মডেলে যে পরিমাণ খরচ হয়েছে তা থেকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয় না।’

টিম মিলার আরও বলেন, ‘গবেষণা নিবন্ধটির ওপর আস্থা রাখা উচিত কি না তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে যৌক্তিক মতামত রয়েছে। তবে এতে এখন পর্যন্ত কোনো গুরুতর সন্দেহজনক দিক আমি দেখিনি। এই অগ্রগতি অবিশ্বাস্য। এটি অত্যন্ত ভালো বলেই অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। তবে ব্যয়ের হিসাব স্পষ্ট নয়।’

তবে টিম মিলার আরও বলেন, কম্পিউটার বিজ্ঞানে মাঝে মাঝে সত্যিকারের যুগান্তকারী উদ্ভাবন ঘটে থাকে। এ ধরনের আকারের মডেল খুব সাম্প্রতিক উদ্ভাবন, তাই এর মধ্যে নতুন দক্ষতা ও কার্যকারিতা আবিষ্কৃত হওয়াই স্বাভাবিক। এটা অনায়াসে অন্যদের কাছেও পুনরুৎপাদনযোগ্য হবে, এটা তারা জানে। তাই যদি তারা সবাইকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করত, তাহলে একেবারে হাস্যকর পরিস্থিতির মুখে পড়ত। ইতিমধ্যেই একটি দল এটি পুনরুৎপাদনের কাজ শুরু করেছে।

অলাভজনক প্রতিষ্ঠান সিভএআইয়ের সহপ্রতিষ্ঠাতা লুকাস হ্যানসেন বলেন, ডিপসিক মার্কিন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ এড়িয়ে গেছে কি না তা নির্ধারণ করা কঠিন। তবে স্টার্টআপটি যে প্রশিক্ষণ বাজেটের কথা বলেছে, তা আর১-এর নয়, বরং ভি-৩-এর, যা ওপেনএআইয়ের জিপিটি-৪-এর সমতুল্য।

লুকাস হ্যানসেন বলেন, জিপিটি-৪-এর প্রশিক্ষণ ২০২২ সালের শেষের দিকে সম্পন্ন হয়েছিল। ২০২২ সালের পর থেকে অ্যালগরিদম ও হার্ডওয়্যারে বহু উন্নতি হয়েছে। এর ফলে জিপিটি-৪ স্তরের একটি মডেলের প্রশিক্ষণের ব্যয় কমিয়ে এনেছে। একই অবস্থা হয়েছিল জিপিটি-২-এর ক্ষেত্রেও। তখন এর প্রশিক্ষণ ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ, কিন্তু এখন মাত্র ২০ ডলারে ৯০ মিনিটে এটি প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব।

হ্যানসেন আরও বলেন, ‘ডিপসিক আর১ তৈরি করেছে একটি বেস মৌলিক মডেল ভি-৩ নিয়ে। তারপর কিছু উদ্ভাবনী কৌশলের মাধ্যমে সেই মৌলিক মডেলকে আরও সুচিন্তিতভাবে কাজ করতে শিখিয়েছে। এই শিক্ষাদান প্রক্রিয়ার খরচ, মৌলিক মডেল প্রশিক্ষণের তুলনায় অনেক কম। এখন যেহেতু ডিপসিক প্রকাশ্যে জানিয়ে দিয়েছে, কীভাবে একটি বেস মডেলকে আরও চিন্তাশীল মডেলে রূপান্তরিত করা যায়, আমরা এখন বিপুলসংখ্যক নতুন চিন্তাশীল মডেলের আবির্ভাব দেখব।’

সরোসপুত্রের সঙ্গে মুহাম্মদ ইউনূসের বৈঠকে মোদি সরকার কি উদ্বিগ্ন

সিল্ক রোডের রস উলব্রিচটকে কেন মুক্তি দিলেন ট্রাম্প

বাংলাদেশে ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা ফিরে আসছে কি?

ট্রাম্পের হাত ধরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া যুগের সূচনা

ইউক্রেনের মোহভঙ্গ, ট্রাম্পের অপেক্ষায় উতলা জেলেনস্কি

হাসিনা পরবর্তী বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ পাকিস্তান, সম্পর্কের রসদ ভারতবিরোধিতা

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান নিয়ে মার্কিন ‘দুমুখো নীতি’ শোধরাবেন কি ট্রাম্প

দিনে শান্তির কথা রাতে গাজায় হামলা, ইসরায়েল কি আদৌ যুদ্ধবিরতি চায়

ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের টানাপোড়েন: সংকটে রোগী আর শিক্ষার্থীরা

বুলডোজার যেভাবে মোদির ভারতের প্রতীক হয়ে উঠল

সেকশন