কর ফাঁকি ও অস্ত্র আইন লঙ্ঘনের দায়ে দণ্ডের মুখে থাকা পুত্র হান্টার বাইডেনকে নির্বাহী ক্ষমতায় ক্ষমা করে ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। জো বাইডেনের এই সিদ্ধান্তে দেশে-বিদেশে শোরগোল উঠেছে। এই ঘটনায় মার্কিন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বাইডেন প্রশাসনের নীতির স্বচ্ছতা নতুন করে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।
শেক্সপিয়ারীয় দ্বন্দ্বের মতো একদিকে পারিবারিক ভালোবাসা, অন্যদিকে রাজনৈতিক দায়িত্ব— কোনটিকে প্রাধান্য দেবেন, তা নিয়ে দোলাচলে ছিলেন বাইডেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত পুত্রের প্রতি ভালোবাসাই জয়ী হলো। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও আইনের শাসনকে সমুন্নত রাখার স্পষ্ট নীতি কালিমালিপ্ত হল। দ্য গার্ডিয়ানের ওয়াশিংটন প্রতিবেদক ডেভিড স্মিথের ভাষায়, পুত্রকে ক্ষমা করে ‘হৃদয়স্পর্শী’ এক ভণ্ডামি দেখালেন বাইডেন।
কারণ, বাইডেন একদিকে বলছেন, পরিবার তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং তিনি সন্তানকে রক্ষার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বিচার ব্যবস্থার প্রতি শ্রদ্ধার কথাও বলেছেন বহুবার।
এই ক্ষমাকে বাইডেন প্রশাসন ‘পারিবারিক ভালোবাসা ও দয়া’ হিসেবে তুলে ধরলেও এটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হিসেবেও দেখা যেতে পারে। বাইডেনের এই পদক্ষেপকে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে দেখছেন সমালোচকরা। এই সিদ্ধান্ত মার্কিন রাজনৈতিক পটভূমিতেও গভীর প্রভাব ফেলতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে পারিবারিক স্বার্থে ক্ষমার প্রথার ব্যবহার নতুন নয়। ক্লিনটন ও বিগত ট্রাম্প প্রশাসনেও এর দেখা মিলেছিল। তবে এই ক্ষমা বাইডেনের রাজনৈতিক ক্যারিয়ারকে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করতে পারে।
বাইডেনের পুত্রকে ক্ষমাকে নেতিবাচক হিসেবে তীব্র সমালোচনা করে নিজের দল ডেমোক্র্যাটিক গভর্নর জ্যারেড পোলিস বলেন, এটি ভবিষ্যতে প্রেসিডেন্টদের জন্য বাজে নজির সৃষ্টি করল। আর রিপাবলিকানরাতো এটিকে ‘পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতি’ হিসেবেই দেখছেন। তাঁরা বাইডেনের শাসনব্যবস্থার প্রতি জনগণের বিশ্বাস ভাঙার চেষ্টা করছেন।
১.৪ মিলিয়ন ডলার কর ফাঁকির মামলায় ২৫ বছরের কারাদণ্ডের মুখোমুখি ছিলেন হান্টার। অস্ত্র মামলায় তাঁর ১৭ বছরের কারাদণ্ড হতে পারত। আদালতে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর চলতি ডিসেম্বরেই তাঁর সাজা ঘোষণা করা হত। কিন্তু এর আগেই পুত্রকে ‘পূর্ণ ও শর্তহীন ক্ষমা’ করলে জো বাইডেন। এর ফলে ২০১৪ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে সব অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে দায়মুক্তি পেলেন হান্টার দিয়েছে। ভবিষ্যতে তাঁর বিরুদ্ধে আর কোনো মামলা করা যাবে না।
বাইডেনের সিদ্ধান্ত তাঁর প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নিয়ে বড় প্রশ্ন তুলেছে। বিচার বিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না বলে বারবার আশ্বস্ত করেও পুত্রের ভালোবাসার কাছে পরাজিত হয়ে বিপরীত পদক্ষেপ নিলেন তিনি। এই সিদ্ধান্তকে ‘ন্যায়বিচারের অপমান’ বলে আখ্যা দিয়েছেন সদ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প। রিপাবলিকানদের দাবি, ছেলেকে ক্ষমার মাধ্যমে ‘পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় রাজনৈতিক শক্তি’র অপব্যবহারের নজির স্থাপন করলেন বাইডেন।
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা রক্ষা করেই ‘মানবিক কারণে’ ক্ষমার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করা হলেও তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে। এফবিআইয়ের পরবর্তী পরিচালকের দায়িত্ব পাওয়া সাবেক ট্রাম্প প্রশাসনের আইনজীবী কাশ্যপ প্যাটেল অভিযোগ করেছেন, বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা নিজেদের পদোন্নতির স্বার্থে রাজনৈতিক শক্তির অনুগত হয়ে কাজ করছেন।
তিনি বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নিয়ে বিচার বিভাগ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবে।
বাইডেনের ছেলেকে ক্ষমার ঘটনার পর আদানির বিরুদ্ধে মামলায় রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বিদেশনীতি ও বিচার বিভাগকে ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন বিশ্লেষকরা। আর এদিকে হান্টারের বিরুদ্ধে ইউক্রেন ও চীনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট আর্থিক অনিয়মের সরাসরি অভিযোগ থাকলেও তাকে বিচার থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় ন্যাটোর কার্যক্রমে পরিবর্তন এবং মার্কিন বিদেশনীতি পুনর্গঠনের এজেন্ডা আছে। তাঁর নেতৃত্বে বিচার বিভাগ ‘ডিপ স্টেট’ বা প্রশাসনিক জটিলতা কমানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর নেতৃত্বে থাকবেন টেক জায়ান্ট ইলন মাস্ক ও ব্যবসায়ী বিবেক রামস্বামী।
সদ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত ডোনাল্ড ট্রাম্প বাইডেন প্রশাসনের এই কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনা করেছেন। তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, তাঁর প্রশাসন মার্কিন বিচার বিভাগ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সংস্কার করবে।
জো বাইডেনের ক্ষমা প্রদানের সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্রের বিচার বিভাগ, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং বিদেশনীতিতে রাজনৈতিক প্রভাব নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্ক তৈরি করেছে। যদিও বাইডেন প্রশাসন দাবি করছে এই সিদ্ধান্ত আইন ও মানবিক মূল্যবোধের ভিত্তিতে নেওয়া হয়েছে। তবে বিরোধী পক্ষ এই পদক্ষেপকে ‘ক্ষমতার অপব্যবহার’ হিসেবে দেখছে।
নিজের পক্ষে বাইডেনেরও যুক্তি আছে, সবারই যেমন থাকে। তিনি বলেছেন, হান্টার সাধারণ কেউ হলে হয়তো এ অভিযোগই উঠত না। তাই তাকে ক্ষমা করা যথার্থ। তিনি বলতে চান, হান্টার শুধু তাঁর ছেলে হওয়ার কারণে ‘রাজনৈতিক প্রতিশোধের উদ্দেশ্যে’ এসব মামলার করা হয়। তাঁকে আঘাত করতেই হান্টারকে হয়রানি করা হয়। নিজের ছেলেকে রক্ষা করার জন্য বাধ্য হয়ে এই পদক্ষেপ নেন তিনি। অবশ্যই এই সিদ্ধান্তের পেছনে হৃদয়ের ভূমিকাকে অস্বীকার করা যায় না। বাবা হিসেবে সন্তানকে রক্ষা করার তাড়না কে দমাতে পারে!
সুতরাং বাইডেনের পদক্ষেপে রাজনৈতিক দায়িত্ব ও পারিবারিক ভালোবাসার এক অভিনব মিশ্রণ ফুটে উঠেছে! কিন্তু এটাকে অবশ্যই এক ধরনের ‘রাজনৈতিক ভণ্ডামি’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। কারণ পরিবারকে ক্ষমার মাধ্যমে প্রেসিডেন্টের ‘রাজনৈতিক স্বার্থ’ নিয়ে প্রশ্ন ওঠা মোটেই অস্বাভাবিক নয়। অনেকেই মনে করেন, এটি তাঁর রাজনৈতিক কৌশলের অংশ। এখন পরবর্তী প্রশাসন এবং বিচার বিভাগের সংস্কার কার্যক্রম কতটা কার্যকর হবে, তা সময়ই বলে দেবে।