ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করা যেকোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার হলেও গত কয়েক বছর ধরে মোবাইল ফোনের কথোপকথন কিংবা ভিডিও ফাঁস এক নিয়মিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ তালিকায় রাষ্ট্রের শীর্ষ ব্যক্তি থেকে শুরু করে মন্ত্রী, এমপি, বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, চিত্রতারকার ফোনালাপ ফাঁসের ঘটনাও রয়েছে। সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত কথাবার্তা কখন, কোথায়, কে ফাঁস করছে, তার তো কোনো ইয়ত্তা নেই।
বছর কুড়ি আগেও অবস্থা এতটা সঙিন ছিল না। প্রযুক্তিগত উন্নতি যত ত্বরান্বিত হয়েছে, ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁসের ঘটনা তত বেড়েছে। এ প্রবণতা শুধু দেশেই নয়, সারা বিশ্বেই বেড়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব প্রাইভেসি প্রফেশনালস (আইএপিপি) জানিয়েছে, গত বছর শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই ১ হাজার ৮৬২টি ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে, যা আগের বছরের তুলনায় ৬৮ শতাংশ বেশি।
এশিয়ার দেশগুলোর অবস্থাও তথৈবচ। গত বছর এ অঞ্চলে সবচেয়ে বেশি গোপনীয়তা লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে ইরানে। সেখানে প্রতি ১০০ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ২৩১টি ইমেইল ফাঁসের ঘটনা ঘটেছে বলে জানিয়েছে নেদারল্যান্ডসভিত্তিক সাইবার নিরাপত্তাবিষয়ক প্রতিষ্ঠান সার্ফশার্ক। শুধু তাই নয়, সার্ফশার্কের তথ্যমতে, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকে (জানুয়ারি-মার্চ) রাশিয়ার ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের মধ্যে ৩৫ লাখ ৫১ হাজার ৩৮৫ জনের তথ্য বেহাত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে এ সংখ্যা ২৪ লাখ ৯৩ হাজার ৭১২, আর ভারতে ৬ লাখ ৭৪ হাজার ৮৪৭। আর সাইবার অপরাধে যুক্তরাজ্য সবার ওপরে। দেশটির প্রতি ১০ লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর মধ্যে সাইবার অপরাধের শিকার ৪ হাজার ৭৮৩ জন।
তবে স্ট্যাটিস্টা বলছে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘন করে তথ্য চুরিতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা। মার্কিন প্রতিষ্ঠানের তথ্যমতে, ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ২১ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি গেছে। একই বছরে যুক্তরাজ্যের ১ কোটি ৭০ লাখ ব্যবহারকারী তথ্য চুরির শিকার হয়। তালিকায় পরের অবস্থানেই রয়েছে কানাডা। অবশ্য ২০২২ সালে এসে এই চিত্রে অনেকটাই বদল এসেছে। সার্ফশার্ক জানাচ্ছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল এই তিন মাসে সবচেয়ে বেশি তথ্যচুরির শিকার হয়েছে রাশিয়া। তালিকায় পোল্যান্ডও উঠে এসেছে বেশ ওপরে। বোঝাই যাচ্ছে ইউক্রেন যুদ্ধ এই চিত্র বদলে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে।
এগারো বছর পর নটনের ভবিষ্যদ্বাণী কতটুকু মিলল, তা বিচার করতে গেলে বিস্মিতই হতে হয়। আমরা আমাদের চারপাশে তাকালেই তাঁর কথার সত্যতা দেখতে পাচ্ছি। দেখতে পাচ্ছি, আমরা আগের চেয়ে অনেক বেশি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি ফোনালাপ ফাঁসের সঙ্গে। এই তো দিনকয়েক আগে ঢাকাই চলচ্চিত্রের অভিনেতা জায়েদ খানকে থাপ্পড় দিলেন আরেক অভিনেতা ওমর সানি। এ নিয়ে যখন আলোচনা তুঙ্গে, তখন হঠাৎ একটি অডিও বার্তা ছড়িয়ে পড়ে ইন্টারনেট দুনিয়ায়। বার্তাটি ওমর সানির স্ত্রী ও ঢাকাই চলচ্চিত্রের এক সময়ের জনপ্রিয় অভিনেত্রী মৌসুমীর। সেখানে তিনি জায়েদকে ‘নির্দোষ’ সাব্যস্ত করে কথা বলেছেন।
সে যাই হোক, প্রশ্নটি হচ্ছে, মৌসুমীর অডিওটি কে বা কারা ফাঁস করল, তা শেষ পর্যন্ত জানা গেল না। এ নিয়ে আর কোনো আলোচনাও নেই। বোঝাই যাচ্ছে, আমরা ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ফাঁসের বিষয়টিতে মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি। এর আগে দেশজুড়ে সবচেয়ে বড় আলোচনার জন্ম দিয়েছিল সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের ফাঁস হওয়া একটি মোবাইল ফোনালাপ। সেই ফোনালাপ ফাঁসের জেরে মন্ত্রিত্ব হারাতে হয় তাঁকে। কিন্তু কে বা কারা ফোনালাপটি ফাঁস করেছে, তা জানা যায়নি। ব্যাপারটাতে আমরা এতটাই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি যে, এ নিয়ে আজ অবধি কেউ প্রশ্নও তোলেনি।
বুঝতে অসুবিধা হয় না, প্রশ্ন তোলার পরিমাণ দিনকে দিন শূন্যের কোটায় নামবে। ক্ষমতাধর প্রতিষ্ঠানগুলো তো বটেই, এমনকি রাষ্ট্র নিজেও নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনকারীর কাতারে নাম লেখাবে। আমরা ইতিমধ্যেই তার কিছু প্রমাণ দেখতে পেয়েছি। বিশ্বের বহু রাষ্ট্র নাগরিকদের ফোনে আড়ি পাতার যন্ত্র কিনেছে। গত বছরের জুলাইয়ে ‘পেগাসাস কাণ্ড’ প্রকাশের পর বিশ্বব্যাপী হইচই পড়ে যায়। বিশ্বের অনেক দেশ ইসরায়েলের কাছ থেকে ফোনে আড়ি পাতার সফটওয়্যার পেগাসাস কিনেছে। সবচেয়ে বেশি কিনেছে আমাদের পাশের দেশ ভারত—এমনটা জানিয়েছে ভারতের সাংবাদিকদের সংগঠন এডিটরস গিল্ড।
এমনটা যে ঘটবে, তার ইঙ্গিত বহু আগে দিয়ে গেছেন প্রখ্যাত ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক জর্জ অরওয়েল। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত ‘১৯৮৪’ উপন্যাসে তিনি বলেছিলেন—‘বিগ ব্রাদার ইজ ওয়াচিং ইউ!’
বিগ ব্রাদারেরা আমাদের দেখবেন, এটাই যেন একুশ শতকের সর্বাধুনিক মানুষের নিয়তি। যদিও নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা করার সাংবিধানিক স্বীকৃতি রয়েছে। তারপরও রাষ্ট্র কেন নাগরিক অধিকার লঙ্ঘনকারী প্রযুক্তি কেনে, সে প্রশ্ন তোলা মানা। তবে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এত সুলভ হলো কী করে, সে প্রশ্ন তো তোলাই যায়।
সেই কারণটা অবশ্য খুঁজে পাওয়া গেল শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সময়ের উপ-উপাচার্য রিচার্ড জোনসের একটি লেখায়। ২০১১ সালে দ্য গার্ডিয়ানে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘ব্যক্তিগত গোপনীয়তা সহজলভ্য হওয়ার পেছনে দায় রয়েছে ‘‘ন্যানো টেকনোলজির’’। বর্তমানে মোবাইল ও ল্যাপটপে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে এই ন্যানো টেকনোলজি।’
স্মার্টফোন ও কম্পিউটারে ব্যবহৃত হয় এক ধরনের ‘চিপ’। এই চিপ তৈরির মূল ভিত হচ্ছে ন্যানো টেকনোলজি। রিচার্ড জোনস জানিয়েছেন, ‘চিপ উৎপাদন সস্তা হওয়ার কারণে স্মার্টফোন ও কম্পিউটারে বহুলভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে চিপ।’
বর্তমানে চিপ উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে চীন। তাইওয়ান সেমিকন্ডাক্টর ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি, যেটি টিএসএমসি নামে বিশ্বব্যাপী পরিচিত, সেটি গত ১৩ জানুয়ারি বলেছে, ২০২২ সালে তারা চিপ উৎপাদনের পেছনে ৪ হাজার ৪০০ কোটি ডলার ব্যয় করবে।
এই প্রথম ইউরোপ-আমেরিকার বাইরে কোনো প্রযুক্তি বিকশিত হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ন্যানো প্রযুক্তি হবে আধুনিক বিশ্বের প্রধান প্রযুক্তি।
সে যা হোক, রিচার্ড জোনস বলেছেন, ‘যে প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার মোবাইল বা ল্যাপটপ চালিত হয়, তা ইতিমধ্যেই ন্যানো স্কেলে কাজ করছে। আগামী ২৫ বছরের মধ্যে এই প্রযুক্তি এমন এক জায়গায় চলে যাবে, তখন আপনার ব্যক্তিগত গোপনীয়তা বলে আর কিছুই থাকবে না।’
রিচার্ডের এই ভবিষ্যদ্বাণী করার পর কেটে গেছে ১১ বছর। আর মাত্র ১৪ বছর অপেক্ষা করার পর জানা যাবে, সত্যি সত্যিই ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ‘অমাবস্যার চাঁদে’ পরিণত হয় কি না।
তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, সার্ফশার্ক, আইএপিপি ডট ওআরজি