পরমাণু শক্তি নিয়ে দ্বিধাহীন হওয়ার সুযোগ এখনো আসেনি। এর বিস্তার বাড়ানো উচিত নাকি কমানো উচিত—তা নিয়ে বিতর্ক জারি আছে বিশ্বজুড়ে। কেউ একে বলছেন আশীর্বাদ, কেউ বলছেন অভিশাপ। আসলেই পরমাণু শক্তি আমাদের জন্য কী; কে করবে তার ফয়সালা?
ফয়সালা যাঁদের হাতে, তাঁরা অবশ্য ব্যাপারটি নিয়ে বেশ উদ্বিগ্ন। গত বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ‘বিশ্ব এখন পরমাণু বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে।’
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির এমন মন্তব্যের পেছনের কারণ হচ্ছে, সম্প্রতি ইউরোপের সবচেয়ে বড় পরমাণু কেন্দ্র জাপোরিঝিরয়ার আশপাশে গোলাবর্ষণ বাড়িয়েছে রুশ বাহিনী। যেকোনো সময় ধ্বংস হয়ে যেতে পারে পরমাণুকেন্দ্রটি।
এমন পরিস্থিতিতে সর্বোচ্চ সতর্কবার্তা উচ্চারণ করেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। ইউক্রেনের লভিভে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে তিনি বলেছেন, ‘পরমাণুকেন্দ্র ধ্বংস করা হবে আত্মহত্যা করার মতো ব্যাপার।’
গুতেরেসের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে তুর্কি প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ানও বলেছেন, ‘আরও একটি চেরনোবিল হোক, তা আমরা চাই না।’
বোঝা যাচ্ছে, পরমাণু শক্তির সঙ্গে এক ধরনের উদ্বেগ জড়িয়ে আছে। কেউই চান না, এটি বিস্ফোরিত হোক বা ধ্বংস হোক। কিন্তু কেন?
দুর্ঘটনার বিশ বছর পেরিয়ে গেলেও চেরনোবিলের আশপাশে ৫০ মাইলের মধ্যে এখনো কোনো মানুষ বাস করে না। সেই ভয়াবহ স্মৃতি স্মরণ করেই এরদোয়ান বলেছেন, ‘আর কোনো চেরনোবিল চাই না।’
পরমাণু শক্তির অপব্যবহারের আরেকটি দগদগে স্মৃতি আছে বিশ্ববাসীর মনে। সেটির নাম হিরোশিমা ও নাগাসাকি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহরে পারমাণবিক বোমা ফেলেছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে বোমা হামলায় শুধু হিরোশিমাতেই মারা গিয়েছিল ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষ। আর নাগাসাকিতে ৭৪ হাজার। পরে পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে বিভিন্ন রোগে মারা গেছেন আরও ২ লাখ ১৪ হাজার মানুষ।
এসব কারণে বিশ্বের যেকোনো বিবেকসম্পন্ন মানুষই পরমাণু শক্তির বিস্তার নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও উদ্বেগে থাকবেন—এটাই স্বাভাবিক। তর্ক-বিতর্ক করাও স্বাভাবিক।
কিন্তু এসব তর্ক-বিতর্ক-দ্বিধা-দ্বন্দ্ব-উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার মধ্যেও থেমে নেই পরমাণু শক্তির বিস্তার। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর দেশ যুক্তরাষ্ট্র ১৯৫৮ সালে প্রথম পরমাণু কেন্দ্র স্থাপন করেছিল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের পরমাণু কেন্দ্র রয়েছে ৫৫ টি।
আরেক শক্তিধর দেশ রাশিয়ার রয়েছে ৩৮টি পরমাণু কেন্দ্র। চীনের রয়েছে ৪৭ টি; আরও ২৩টি নির্মাণাধীন। উত্তর কোরিয়ার রয়েছে ২২ টি। আমাদের পাশের দেশ ভারতের রয়েছে ২২টি পরমাণু রিঅ্যাক্টর, আর পাকিস্তানে রয়েছে ছয়টি পরমাণুকেন্দ্র।
এসব পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, বিশ্বের বহু দেশ পরমাণু শক্তির দিকে ঝুঁকেছে। কিন্তু কেন? এর একটি অন্যতম কারণ বিদ্যুৎ উৎপাদন। বর্তমানে সারা বিশ্বের মোট বিদ্যুতের ১০ শতাংশ সরবরাহ করা হচ্ছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে।
যুক্তরাজ্য ২০২০ সালে তাদের মোট বিদ্যুতের ১৬ শতাংশ উৎপাদন করেছে পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। ২০২৫ সালের মধ্যে তারা এটি ২৫ শতাংশে উন্নীত করতে চায়। বর্তমানে যুক্তরাজ্যের পরমাণুকেন্দ্র রয়েছে আটটি।
ফ্রান্স বর্তমানে ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করে পরমাণুকেন্দ্র থেকে। এই মুহূর্তে ৫৬টি পরমাণু রিঅ্যাক্টর রয়েছে ফ্রান্সের। আরও ছয়টি নির্মাণাধীন।
বেলজিয়ামের সাতটি পরমাণু রিঅ্যাক্টর রয়েছে। দেশটি তার মোট বিদ্যুতের অর্ধেকই উৎপাদন করে পরমাণুকেন্দ্র থেকে। গত মার্চে আরও দুটি নতুন পরমাণু চুল্লিতে বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বেলজিয়াম সরকার।
এদিকে দক্ষিণ কোরিয়া ঘোষণা দিয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে আরও চারটি পরমাণু রিঅ্যাক্টর স্থাপন করবে এবং পুরোনো ১০টি চুল্লিকে আরও বড় করবে।
২০১১ সালে জাপানের ফুকুশিমা পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বিপর্যয়ের পর জার্মানি তাদের ১৭টি পরমাণুকেন্দ্র বন্ধ করে দিয়েছিল। সেগুলো এখন পুনরায় চালুর চিন্তাভাবনা করছে জার্মানি।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় পারমাণবিক জ্বালানি রপ্তানিকারক দেশ রাশিয়া সম্প্রতি মিসর ও তুরস্কে নতুন পরমাণুকেন্দ্র স্থাপন করেছে। রাশিয়ার পরমাণু জ্বালানি ব্যবসা মিয়ানমার থেকে উগান্ডা পর্যন্ত বিস্তৃত।
নেদারল্যান্ডস নতুন দুটি পরমাণু চুল্লি স্থাপনের কথা ভাবছে। পোল্যান্ড প্রথমবারের মতো পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্র ও হাঙ্গেরিও নতুন পরমাণুকেন্দ্র তৈরির পরিকল্পনা করছে।
সুতরাং পরিবেশবাদীরা যতই চেরনোবিল-ফুকুশিমার কথা বলুন না কেন, যতই হিরোশিমা-নাগাসাকির কথা বলুন না কেন, দেশে দেশে পরমাণুকেন্দ্র স্থাপন থেমে নেই। ভবিষ্যতে আরও বাড়তে থাকবে বলেই ধারণা করা যায়।
অতএব, আশীর্বাদ হিসেবেই হোক আর অভিশাপ হিসেবেই হোক, ভবিষ্যতের পৃথিবীতে পরমাণু শক্তির বিস্তার যে বাড়বে, তা হলফ করেই বলা যায়। আর এর পেছনে প্রকাশ্য মূল কারণ বিদ্যুতের জোগান। তবে ইউরোপজুড়ে, বিশেষত জার্মানি, ফ্রান্সের মতো দেশগুলো যে শুধু বিদ্যুতের জোগান মাথায় রেখেই এর পরিধি বাড়াচ্ছে না, তা যে কেউ বুঝবে। ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে যে ক্ষমতা-সমীকরণ তৈরি হয়েছে, তাতে এই শক্তির বিস্তার আদতে নিজেদের খুঁটিটি পোক্ত করতে চাওয়ার কারণেই। তারা মূলত রাশিয়ার পরমাণু শক্তি অর্জনে বিভিন্ন দেশকে সহযোগিতা করা, চীনে পরমাণু কর্মসূচির বিস্তৃতির পাল্টা হিসেবেই এ পথে হাঁটছে। বিশ্বজুড়ে ক্রমেই প্রকট হয়ে ওঠা ক্ষমতার নয়া সমীকরণকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা থেকেই তারা এই সময়ে এ ধরনের কর্মসূচিতে মনোযোগ বাড়াচ্ছে।
তথ্যসূত্র: ব্লুমবার্গ, বিবিসি, ফক্স নিউজ, আইএইএ, যুক্তরাষ্ট্রের জ্বালানি তথ্য প্রশাসনের ওয়েবসাইট