হোম > সারা দেশ > চট্টগ্রাম

বড় ভাইয়ের ক্ষমতায় কাদের মির্জার দাপট

মিজানুর রহমান রিয়াদ, নোয়াখালী

কাদের মির্জা। ফাইল ছবি

নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বসুরহাট পৌরসভার সাবেক মেয়র আবদুল কাদের মির্জা। এলাকার সর্বক্ষেত্রে বেপরোয়া ছিলেন তিনি। সন্ত্রাস, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ, টেন্ডারবাজি, নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য, রাজনৈতিক মুক্তিপণ আদায়, চাঁদাবাজি, দখলসহ নানা অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। তাঁর সব দাপটের মূলে ছিলেন বড় ভাই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, শুধু রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নয়, নিজ দলের প্রতিদ্বন্দ্বীদেরও দমিয়ে রাখতে তিনি সব অপকৌশল প্রয়োগ করেছেন। ক্ষমতাকে একচ্ছত্র করার জন্য তাঁর ছিল হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনী। প্রশাসন ও পুলিশ—সবই ছিল কাদের মির্জার নিয়ন্ত্রণে। কোনো কর্মকর্তা তাঁর মতের বিপরীতে অবস্থান নিলেই বড় ভাই ওবায়দুল কাদেরকে দিয়ে তাঁকে বদলি করিয়ে দিতেন।

হেলমেট ও হাতুড়ি বাহিনী

দুই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন কাদের মির্জার ছেলে তাশিক মির্জা, বসুরহাট পৌরসভার কাউন্সিলর ও যুবলীগ নেতা মো. রাসেল, হামিদ উল্যাহ ওরফে কালা হামিদ, সাবেক ছাত্রলীগ সভাপতি আবদুল আউয়াল মানিক, উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আইনুল মারুফ, সাধারণ সম্পাদক মো. তন্ময়, বসুরহাট পৌরসভা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক জিসান আহমেদ, সানিম, বোরহান উদ্দিন, শহিদ উল্যা ওরফে কেচ্ছা রাসেল, বাংলাবাজারের পিচ্চি মাসুদ ওরফে ডাকাত মাসুদ।

এর মধ্যে ২০২১ সালের ১৩ মে বসুরহাট পৌরসভার করালিয়া এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুরের অনুসারীদের দিকে গুলি ছোড়ার একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। পরে গ্রেপ্তার হলেও কাদের মির্জার দাপটে কিছুদিন পরই কেচ্ছা রাসেল জামিনে ছাড়া পান।

দুই বাহিনীর অস্ত্রধারীদের হাতে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান, সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুর নবী চৌধুরী, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি খিজির হায়াত খান, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা জায়েদুল হক কচি, স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা শাহাজান সাজু, উপজেলা বিএনপির সদস্যসচিব মাহমুদুর রহমান রিপন, জামায়াত নেতা ইয়াকুব নবীসহ অনেকে।

২০২৩ সালের ১১ ডিসেম্বর মির্জা বাহিনীর সদস্যরা কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাংবাদিক নাজিম উদ্দিনকে পিটিয়ে আহত করেন। পরে কাদের মির্জার এক অনুসারী বাদী হয়ে নাজিমের বিরুদ্ধে উল্টো মাদক আইনে মামলা করেন।

হত্যায় অভিযুক্ত কাদের মির্জার বাহিনী

দলীয় ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ অর্থ উপার্জনের টাকা ভাগ-বাঁটোয়ারাকে কেন্দ্র করে কাদের মির্জা ও তাঁর ভাবি ইসরাতুন্নেসার মধ্যে পারিবারিক দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে বড় ভাই ও ভাবির বিরুদ্ধে কাদের মির্জা ফেসবুকে লাইভে এসে ক্রমাগত কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিতে থাকেন। এর প্রতিবাদে মাঠে নেমেছিল আওয়ামী লীগেরই একটি অংশ। ২০২১ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি চাপরাশির হাটে প্রতিপক্ষের মিছিলে হামলা চালায় কাদের মির্জার বাহিনী। গুলিবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান স্থানীয় সাংবাদিক বুরহান উদ্দিন মুজাক্কির। এ ঘটনায় মামলা হলেও কারও নাম উল্লেখ করার সাহস পায়নি মুজাক্কিরের পরিবার। একই ঘটনায় শ্রমিক লীগ কর্মী আলাউদ্দিন গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন।

আওয়ামী লীগও জিম্মি ছিল

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘ ১৬ বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্র অনুমোদিত কোনো কমিটি ছিল না। কাদের মির্জা নিজেই একই দিন একাধিক কমিটি ঘোষণা করতেন। তিনি সকালে একটি কমিটি দিয়ে বিকেলে আবার আরেকটি কমিটি ঘোষণা দিতেন। কাদের মির্জার পরিবারের কাছে জিম্মি ছিলেন কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের নেতারা।

কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান বলেন, কোম্পানীগঞ্জ আওয়ামী লীগ ছিল কাদের মির্জার কাছে জিম্মি। তাঁরা দুই ভাই মিলে সন্ত্রাসী কার্যক্রম, অবৈধ টাকা উপার্জনে দলকে ব্যবহার করে আসছিলেন। আমরা আওয়ামী লীগ করেও সব সময় আতঙ্কে ছিলাম। দুই ভাই মিলে পুরো এলাকাকে আতঙ্কের জনপদে পরিণত করেছেন।

ব্যবসায়ীদের ওপর হামলা, প্রতিষ্ঠান দখল

কাদের মির্জা তাঁর বাহিনী দিয়ে এলাকার বহু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যবসায়ীর ওপর হামলা-নির্যাতনের ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে ভুক্তভোগীদের অভিযোগ। এর মধ্যে সাত্তার ব্রাদার্স (সাত্তার বেকারি), ফখরুল ক্লথ স্টোর, হুমায়ূন টিম্বার, ফিরোজ অ্যান্ড ব্রাদার্স, ফেন্সী হোটেল, আজমীর হোটেল, গাজী অ্যান্ড সন্স, ছায়েদ ম্যানশন (ছয়তলা বিপণিবিতান ও আবাসিক ভবন), কাউন্সিলর ছায়েদল হক বাবুলের আলেয়া টাওয়ার, মাওলা শপিং সেন্টার, মডার্ন হাসপাতাল, ডায়াবেটিক হাসপাতাল, হেলাল হার্ডওয়্যার, সেলিম স্টোর, মেহরাজ প্লাজা বন্ধ করে দেওয়া হয়। পরে চাঁদা নিয়ে খুলে দেওয়া হয় সেগুলো।

ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা জানান, বসুরহাট বাজারে মেইন রোডে লন্ডনপ্রবাসী আবু ছায়েদের ছয়তলার ছায়েদ ম্যানশন ও হাসপাতাল গেটে জাহান মঞ্জিল নামে চারতলা ভবন দখল করে নেন কাদের মির্জা। ছায়েদ ম্যানশনের ছয়তলা ভবনটি থেকে পৌরসভার কর্মচারীদের দিয়ে ভাড়া তুলতেন। জাহান মঞ্জিলের মালিক আবু ছায়েদকে নামকাওয়াস্তে কিছু টাকা দিয়ে বিক্রি করে দেন নিজ দলের নেতা ইস্কান্দার মির্জা শামীমের কাছে। তবে ৫ আগস্টের পর ভবনটি দখলমুক্ত হয়ে আবু ছায়েদের মালিকানায় যায় বলে জানা গেছে। বসুরহাট রূপালী চত্বরে কাউন্সিলর ছায়েদুল হক বাবুলের স্ত্রী আলেয়া বেগমের মালিকানাধীন আলেয়া টাওয়ার নামে চারতলা ভবনটি নিজ স্ত্রী আক্তার জাহান বকুলের নামে লিখে নেন কাদের মির্জা। পৌরসভা টর্চার সেলে বাবুল ও তাঁর স্ত্রী আলেয়াকে আটক করে এটি করেন তিনি।

বসুরহাট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবদুল মতিন লিটন বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর থেকে কাদের মির্জা নানা অজুহাতে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নিতেন। তাঁর অত্যাচারে জেলার অন্যতম ব্যবসাকেন্দ্রের ব্যবসায়ীরা অনেকটা পথে বসার উপক্রম হয়েছিলেন, যা এখনো স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরেনি।

২০২১ সালের ২০ সেপ্টেম্বর বসুরহাট বাজারের আমিন মার্কেটের মালিক আশিক-ই-রসুলকে কাগজপত্র নিয়ে পৌরসভা কার্যালয়ে ডেকে নেওয়া হয়। কাদের মির্জার নির্দেশে পৌর সচিব ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। টাকা না দেওয়ায় ২৭ সেপ্টেম্বর বিকেলে ওই মার্কেটের প্রধান ফটকে তালা ঝুলিয়ে দেন কাদের মির্জা। আশিক-ই-রসুল বলেন, ‘টাকা দেওয়ার পর আমার মার্কেটের তালা খুলে দেওয়া হয়।’

প্রশাসন ও চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ

স্থানীয়রা জানান, সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয় ছাড়াও ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে কয়েকটি মন্ত্রণালয় এবং প্রশাসনের নিয়োগ ও বদলি-বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে রেখেছিলেন কাদের মির্জা। বিশেষ করে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয়ে কাদের মির্জা ও তাঁর ভাবি (ওবায়দুল কাদেরের স্ত্রী) ইসরাতুন্নেসা কাদেরের দুটি আলাদা সিন্ডিকেট ছিল। তবে এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ বক্তব্য দিতে চাননি।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ঠিকাদার জানান, কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও বসুরহাট পৌরসভায় যেকোনো উন্নয়নকাজ করতে গেলে কাদের মির্জাকে নির্দিষ্ট অঙ্কের চাঁদা দিতে হতো ঠিকাদারদের। না দিলে কাজ বন্ধ করে দিতেন তাঁর বাহিনী দিয়ে। আবার এসব কাজের বেশির ভাগ পেতেন তাঁর ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারেরা। গত ১৫ বছরে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা ও বসুরহাট পৌরসভায় মোট উন্নয়নকাজ যা হয়েছে, প্রতিটি কাজে ৫ থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নিতেন কাদের মির্জা। একাধিক ঠিকাদার এ তথ্য দিয়েছেন।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে আছেন কাদের মির্জা ও তাঁদের পরিবারের সদস্যরা। অভিযোগের বিষয়ে জানতে কাদের মির্জার ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

ইমনের স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা

কৃষিজমির মাটি কেটে বিক্রির মহোৎসব

ফেসবুক লাইভে ওসিকে পেটানোর হুমকি: শীর্ষ সন্ত্রাসী সাজ্জাদকে ধরতে পুরস্কার ঘোষণা

রাউজানে কৃষিজমি থেকে মাটি কাটার দায়ে ২ জনকে জরিমানা

হাটহাজারীতে হোটেলে পুড়ে আহত এক, ২ কোটি টাকার ক্ষতি

সীতাকুণ্ড ডিসি পার্কের ফুলমেলা জমজমাট, ২৬ দিনে আয় আড়াই কোটি টাকা

হামলা মামলায় মতলব উত্তর আ.লীগ নেতা শাহজাহান গ্রেপ্তার

কক্সবাজার সৈকতে আরও ১৪টি মৃত কচ্ছপের খোঁজ

ফেসবুক লাইভে এসে ওসিকে নগ্ন করে পেটানোর হুমকি সন্ত্রাসী সাজ্জাদের

চৌদ্দগ্রামে ১০ মামলার আসামি যুবলীগ নেতা সুমন গ্রেপ্তার

সেকশন