চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট পরিচালনা একের পর এক গুটিয়ে নিচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইনস। বর্তমানে মাত্র দুটি এয়ারলাইনস দিয়ে যাত্রীসেবা দেওয়া হয়েছে। এতে বিপাকে আছেন সাধারণ যাত্রীরা। এর মধ্যে ওমরাহর মৌসুমে এবার চুপিসারে ফ্লাইট কমিয়ে দিল দেশীয় এয়ারলাইনস বিমান বাংলাদেশও।
আগে মদিনা-চট্টগ্রাম সোমবার ও শুক্রবার দুটি ফ্লাইট ছিল। তবে গত অক্টোবর থেকে শুক্রবারের ফ্লাইটটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। সম্প্রতি বিষয়টি আলোচনায় আসে। এর আগে গত এক বছরে চার বিদেশি এয়ারলাইনস এই বিমানবন্দর ছেড়েছে। এখন সেখানে আছে মাত্র দুটি বিদেশি প্রতিষ্ঠান। দুই যুগ আগে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর পর এ পর্যন্ত ১৪টি বিদেশি এয়ারলাইনস বিমানবন্দর ছেড়েছে।
বিমান কর্মকর্তারা জানান, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হিসেবে শাহ আমানত বিমানবন্দরে পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা না থাকায় এখান থেকে বিদেশি এয়ারলাইনসগুলো একের পর এক গুটিয়ে নিয়েছে।
সর্বশেষ গত ১ সেপ্টেম্বর থেকে আমিরাতভিত্তিক ফ্লাই দুবাই শাহ আমানত বিমানবন্দরে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে। এর আগে ৮ মার্চ ওমান এয়ার; ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষ দিকে ভারতভিত্তিক স্পাইস জেট এবং কুয়েতভিত্তিক জাজিরা এয়ারওয়েজ ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করেছে। এর আগে ফ্লাইট পরিচালনা বন্ধ করে থাই এয়ার, থাই স্মাইল এয়ার, কুয়েত এয়ার, ফুকেট এয়ার, মালিন্দো এয়ার, রোটানা এয়ার, হিমালয়ান এয়ার, রাস আল কাইমা এয়ার, টাইগার এয়ারওয়েজ, সিল্ক এয়ার, ভারতভিত্তিক স্পাইসজেট, কুয়েতভিত্তিক জাজিরা এয়ারওয়েজ ও ওমান এয়ার। তবে সিভিল এভিয়েশনের দাবি, কুয়েত এয়ার, ফুকেট এয়ার ও সিল্ক এয়ার কখনো এ বিমানবন্দর থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করেনি।
বিমানবন্দর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে চট্টগ্রাম থেকে আন্তর্জাতিক রুটের ফ্লাইট পরিচালনাকারী চারটি এয়ারলাইনসের মধ্যে দুটি বিদেশি সংস্থা হলো এয়ার অ্যারাবিয়া ও সালাম এয়ার। আর দেশি দুটি হলো বিমান বাংলাদেশ ও ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনস।
বিমানবন্দরের তথ্য, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে ২০০০ সালে বিদেশি ফ্লাইট সরাসরি চালুর পর যাত্রীর সংখ্যা বার্ষিক ৬ লাখ থেকে বেড়ে ১৬ লাখে দাঁড়িয়েছে। ২০২৩ সালে এই বিমানবন্দর দিয়ে আন্তর্জাতিক রুটের যাত্রী চলাচল বেড়েছে সাড়ে ৮ শতাংশ। ২০২৩ সালে ৯ লাখ ৬৮ হাজার যাত্রী আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গন্তব্যে গেছেন। তাঁদের মধ্যে প্যাসেঞ্জার বিল্ডিংয়ের সক্ষমতা কম। ৬ লাখ যাত্রীর সক্ষমতা দিয়ে ১৬ লাখ হ্যান্ডলিং করা হচ্ছে। ফলে অনেক ভোগান্তি তৈরি হচ্ছে। চট্টগ্রাম বিমানবন্দরের রানওয়ে দিয়ে এখন বাংলাদেশে আসা সবচেয়ে বড় উড়োজাহাজ ‘বোয়িং ৭৭৭’ কিংবা ‘বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার’ এবং ‘এয়ারবাস এ-৩২০’ নামতে পারে। রানওয়ের সমস্যা নেই। তবে একসঙ্গে ৩০০-৪০০ যাত্রীর ইমিগ্রেশন সম্পন্ন করার জন্য পর্যাপ্ত কাউন্টার নেই। ব্যাগেজ বেল্টও পর্যাপ্ত নেই। বিমানবন্দরে থাকা দুটি লাগেজ বেল্ট একসঙ্গে কাজে লাগিয়েও যাত্রী সামাল দেওয়া যায় না। বেল্টকক্ষেই যাত্রীদের জটলা লেগে যায়। আর যাত্রী বেশি হওয়ায় একেকটি লাগেজ পেতে অপেক্ষায় থাকতে হয় দেড় ঘণ্টার বেশি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এয়ারলাইনস কর্মকর্তারা জানান, চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে এখনো দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যাত্রীবাহী ফ্লাইট চলাচল করে না। কিন্তু আন্তর্জাতিক রুটের বেশির ভাগ বিমান সংস্থাই ২৪ ঘণ্টা ফ্লাইট চলাচলের ব্যবস্থা চায়। বিদেশি বিমান সংস্থার ফ্লাইট না থাকায় চট্টগ্রামভিত্তিক যাত্রীদের হয় ঢাকা শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে বিদেশে যেতে হচ্ছে; অথবা সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা ওমানের মাসকাট হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা-চীনসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গন্তব্যে যেতে হচ্ছে। এতে আকাশপথে ভ্রমণ নিরবচ্ছিন্ন না হওয়ার পাশাপাশি বাড়তি সময় ও খরচ বেশি লাগছে বলে অভিযোগ যাত্রীদের।
এদিকে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসেও চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে দেশি-বিদেশি ছয়টি উড়োজাহাজ প্রতিদিন ওমরাহ যাত্রী পরিবহন করেছিল। অথচ চলতি বছরের একই সময়ে ওমরাহ যাত্রী পরিবহন করছে তিনটি এয়ারলাইনস। এগুলোর মধ্যে দেশীয় পতাকাবাহী বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস সরাসরি সৌদি আরবে গেলেও সপ্তাহে ফ্লাইট যাচ্ছে মাত্র তিনটি। বাকি দুটি অন্য দেশের যাত্রী নিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। তাতে দীর্ঘ সময়ক্ষেপণের পাশাপাশি যাত্রীদের ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত অর্থ। অবশ্য, যাত্রীদের এমন বেহাল অবস্থা নিরসনে চট্টগ্রাম থেকে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের আরও ফ্লাইট বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ট্রাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশ (আটাব)।
তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সপ্তাহে চট্টগ্রাম-জেদ্দা রুটে তিনটি নিয়মিত এবং চট্টগ্রাম-মদিনা রুটে একটিসহ চারটি ফ্লাইট পরিচালনা করত রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস। বর্তমানে সপ্তাহের প্রতি শুক্রবার মদিনা-চট্টগ্রাম একটি ফ্লাইট চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ওমরাহ যাত্রীদের আসনসংকটে পড়তে হয়।
অন্যদিকে, দুটি বিদেশি এয়ারলাইনস ওমরাহ যাত্রী পরিবহন করলেও ট্রানজিটের সময় একটি বিমানের ৬-৭ ঘণ্টা অপেক্ষা করা এবং অন্যটির টিকিটের মূল্য বেশি হওয়ায় যাত্রীরা স্বচ্ছন্দবোধ করেন না বলে জানান এজেন্সিগুলোর মালিকেরা।
হজ এজেন্সিজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (হাব) চট্টগ্রাম জোনের সাবেক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ শাহ আলম বলেন, ‘যেহেতু চট্টগ্রাম থেকে সৌদি আরবের সরাসরি অন্য কোনো ফ্লাইট নেই, তাই বিমান বাংলাদেশ চাইলে রুটটিতে আরও দু-তিনটি ফ্লাইট বাড়াতে পারে। এ রুটে ফ্লাইট বাড়ানো প্রয়োজন। আগে অন্য বিমানের কানেকটিং ফ্লাইট দিয়ে যাতায়াত করলেও কয়েকটি এয়ারলাইনস তাদের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। তাতে বিপাকে আছেন ওমরাহ যাত্রীরা। বর্তমানে যে সংকট তৈরি হয়েছে, রাষ্ট্রীয় বিমান বাংলাদেশ চাইলে তা পূরণ করতে সক্ষম।’
ফ্লাইট বন্ধের বিষয়ে বিমান বাংলাদেশের পরিচালক (ফ্লাইট অপারেশন) ক্যাপ্টেন তাসনিম দোজা জানেন না বলে দাবি করেন। শাহ আমানত বিমানবন্দরে জনসংযোগ কর্মকর্তা প্রকৌশলী ইব্রাহিম খলিল বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বিমানবন্দর থেকে দুটি দেশীয় এবং দুটি বিদেশি মিলিয়ে মোট চারটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালু রয়েছে।