‘রাত ঠিক তখন দেড়টা। হঠাৎ প্রচণ্ড ঝড়ের কবলে পড়ে উল্টে যায় ট্রলারটি। অথচ এর কিছুক্ষণ আগে জেলেরা সাগরে জাল ফেলে যে যার মতো ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ঘুম আসার আগে মাঝির ডাকে অনেকে আবার ট্রলারের ওপরে উঠে আসে। কিন্তু ততক্ষণে একটা ঢেউয়ের আঘাতে উল্টে যায় আমাদের ট্রলারটি। ট্রলারে থাকা ১৫ জনের মধ্যে সাতজন সাগরে পড়ে যান। তখন অনেকটা ডুবে যাওয়া ট্রলারের ওপরের অংশ ধরে ভাসতে থাকেন চারজন। আমিসহ অপর তিনজন তখনো সাগরে ছিলাম। প্রথম দিকে ট্রলারের পাশ ধরে কিছুক্ষণ ঝুলে থাকলেও তা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি। পরপর একাধিক ঢেউয়ের আঘাতে ট্রলারের পাশ থেকে আমরা অনেক দূরে চলে যাই। এতে নিশ্চিত মৃত্যু ভেবে ট্রলারের সঙ্গে থাকা চারজনের কাছ থেকে চিৎকার দিয়ে চিরবিদায়ও নিয়েছিলাম।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে বিভীষিকাময় ওই দিনের কথাগুলো বলছিলেন ট্রলারডুবির চার দিন পর জীবিত উদ্ধার হওয়া নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার জাহাজমারা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা আফছার উদ্দিন।
আফছার উদ্দিন বলেন, ‘চিরবিদায় নেওয়ার পর আমি আর সোহেল সাগরে থাকা বাঁশের সঙ্গে বাঁধা একটি তেলের ড্রামের দুপাশ ধরে ঝুলে থাকলেও আমাদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় জাফর উদ্দিন। সকালের সূর্য ওঠার পর আমি আর সোহেল ড্রামটি ধরে থাকলেও আশপাশে কোথাও জাফরকে দেখা যায়নি। এরপর শুরু হয় ঝড়, বৃষ্টি আর ঢেউয়ের সঙ্গে যুদ্ধ করে আমাদের বেঁচে থাকার লড়াই। একে একে চার দিন পার হওয়ার পরও যখন আশপাশে কোনো ট্রলার বা জাহাজ দেখা যাচ্ছিল না, তখন বাঁচার শেষ আশাটুকু ছেড়ে দিয়েছিলাম। অন্যদিকে শরীরের অনেক অংশ ঠুকরে খেয়েছে সামুদ্রিক মাছ।’
ডুবে যাওয়া ট্রলারের মালিক হাতিয়ার জাহাজমারা আমতলী গ্রামের বাসিন্দা লুৎফুল্লাহিল মজিব নিশান সরকারের কাছে দাবি করে বলেন, ‘দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সাগরে মাছ শিকার করা জেলেরা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছেন। কিন্তু এই আর্থিক সেক্টরটির দিকে সরকারের তেমন সুদৃষ্টি নেই। সাগরে মাছ ধরতে যাওয়া প্রতিটি ট্রলারে যদি জিপিএস ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু থাকে, তাহলে অন্তত এসব দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটত না। সাগরের যেকোনো সীমান্তে আটকা পড়লে দুর্ঘটনাকবলিত ট্রলারটি পার্শ্ববর্তী ট্রলারের অবস্থান যেনে সহযোগিতা পেত। তাই ট্রলারমালিকদের কাছ থেকে নির্দিষ্ট মূল্য নিয়ে হলেও জিপিএস সিস্টেম চালু করার দাবি জানাচ্ছি।’
উল্লেখ্য, গত ৯ আগস্ট রাতে বঙ্গোপসাগরের মইডুবি এলাকার সাগরের মোহনায় ঝড়ের কবলে পড়ে ১৫ জেলে নিয়ে ডুবে যায় এফবি নিশাত নামের ট্রলারটি। ওই দিন পার্শ্ববর্তী একটি ট্রলারের সাহায্যে চার জেলেকে উদ্ধার করা হয়। এর চার দিন পর আরও তিনজনকে জীবিত উদ্ধার হয়েছে। এ ঘটনায় এখনো আট জেলে নিখোঁজ রয়েছেন।