শুরুটা ছিল বন্ধুর। ভাগ্য বদলাতে খামার করতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগে হয়েছিল বেজায় ক্ষতি। এরপর ধার–দেনায় আবার নতুন করে শুরু। এখন নাইক্ষ্যংছড়ির দুর্গম এলাকায় পুলক বড়ুয়ার খামারে মেলে ২২ জাতের আম। শুধু তাই নয়, এলাকার অসুস্থ, গর্ভবতী নারী ও শিশুরা বিনা মূল্যে এই খামার থেকে পায় ফলমূল।
বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলায় ব্যানানা ম্যাঙ্গো, থাইল্যান্ডের নাম ডক মাই, গৌড়মতী, মহাচানক, সূর্যডিম্ব, হিমসাগর, আশ্বিনা, মল্লিকা, চৌষা, কাটিমোহন ও বারি-৪ জাতের আমগুলো প্রথমবারের মতো পরীক্ষামূলকভাবে চাষ করেন খামারি পুলক বড়ুয়া (৪৬)। একই সঙ্গে তিনি লিচু, ড্রাগন, লেবু, পেঁপে ও শীতকালীন সবজিও চাষ করছেন।
পুলক জানান, ১৯৯৩ সালে রামু খিজারী আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পাশ করেছিলেন তিনি। তবে দারিদ্র্যের কারণে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা আর দেওয়া হয়নি তাঁর। ভাগ্য বদলাতে ঝুঁকে পড়েন কৃষিতে। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে তিন বন্ধু মিলে লেবু, পেঁপে ও শীতকালীন সবজি দিয়ে শুরু করেন খামার। কক্সবাজার রামু উপজেলা থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে খামারটির অবস্থান। এটি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার মারেগ্যাপাড়ার বৈদ্যপাড়ার ‘তরুপল্লব বহুমুখী প্রাকৃতিক খামার’ নামে পরিচিত।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় চার একর জায়গাজুড়ে প্রায় ১২ প্রজাতির ফলদ গাছ আছে খামারে। সেখানে থোকায় থোকায় ধরে আছে আম। সেগুলোর মধ্যে কোনটি লম্বা, কোনটি গোল, কিছু আম আবার ছোট। পাশাপাশি ড্রাগন ও লিচু গাছেও এসেছে মুকুল। অনেক গাছে ধরেছে বিভিন্ন জাতের লেবু। খামারে পেয়ারা পেকে লাল হয়ে আছে। এলাকাটি পাখির কিচিরমিচির শব্দে সারাক্ষণ মেতে থাকে।
খামারের বিষয়ে পুলক বড়ুয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার খামারে আম্রপালি, মল্লিকা, হাঁড়িভাঙা, থাইল্যান্ডের নাম ডক মাই, ব্যানানা ম্যাঙ্গো, ইন্ডিয়ান চৌষা, জাপানি মিয়াজাকিসহ আরও ২২ জাতের আম আছে। বাগানের একপাশে রয়েছে কয়েকটি ভালো জাতের পেয়ারা, পেঁপে ও মাল্টা গাছ। হাতির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে রোপণ করা ড্রাগন ফলের গাছ থেকেও এ বছর প্রায় ৬০০ কেজি ফল পাওয়ার আশা আছে।’
বাগানের কোনো গাছেই ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার করেন না পুলক বড়ুয়া। তিনি জানান, শুধুমাত্র জৈব সার দেওয়া হয়। তবে পোকা দমনের জন্য তিনটি পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলের মাছি-পোকা দমনে ইয়েলো কার্ড, সাইড ফেরমুন ট্যাব, ফ্রুট ব্যাগিং পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বৈদ্যপাড়ার ওই গ্রামের বেশির ভাগ জনগোষ্ঠী রাখাইন ও মারমা সম্প্রদায়ের। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, অনেক গর্ভবতী মহিলা ও শিশুরা প্রায় সময় বাগানের বিভিন্ন ফলমূল বিনা মূল্যে নিয়ে যেতে পারেন। মারেগ্যপাড়ার ইউপি সদস্য থোইয়্যংকা যাই আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পুলকের ফলজ খামার থেকে আমাদের এলাকার একাধিক নারী, পুরুষ ও বৃদ্ধরা পুষ্টির চাহিদা মেটান। বিনা মূল্যেই বেশির ভাগ মানুষ তাঁর বাগান থেকে ফলমূল নিয়ে আসেন।’
খামার করতে ফল বিজ্ঞানী ও কৃষিবিদ সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সাবেক দুই মহাপরিচালক এম. এনামুল হক ও এস. এম কামরুজ্জামান নিয়মিত পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করছেন পুলককে। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় তথ্য খুঁজতে অনলাইন মাধ্যমকেও ব্যবহার করছেন তিনি।
খামারের বিষয়ে সরকারি কৃষি অফিস থেকে পর্যাপ্ত সহায়তা পেলে সুবিধা হতো বলে জানান পুলক বড়ুয়া। তিনি বলেন, ‘দু-একবার আম ও মাল্টা গাছের চারা দেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো ভালো জাতের না হওয়ায় শুধু শুধু সময় আর শ্রম ব্যয় হয়। লাভের চেয়ে বরং ক্ষতি হয়েছিল। যদি সরকারি প্রণোদনা ও সহজ শর্তে মাঝারি অঙ্কের ঋণ দেওয়া হয় তাহলে দেশের অনেক বেকার যুবকেরা কৃষিতে মনোযোগী হবেন।’
এ বিষয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা সালমা ফেরদৌস আজকের পত্রিকাকে বলেন, পাহাড়ি এলাকায় তামাকের বদলে ফলজ, বনজ ও উৎপাদনমুখী কৃষিতে উৎসাহ দেওয়া হয়। উপজেলার পক্ষ থেকে সব সময় এসব উদ্যোক্তাদের নানা রকম সহায়তা দেওয়ার চেষ্টা চলে।