‘গাংঙ্গের ভাঙ্গনের পরে পানিতে ঘরদুয়ার সব ভাসাইয়া নিছে। ভাঙ্গার পর থেকে এখনো আমরা বেড়িবাঁধের রাস্তার উপর খোলা আকাশের নিচে থাকছি। রোদ–ঝড়-বৃষ্টি, মশার কামড় সব সহ্য করতে হচ্ছে। কোনো উপায় নাই। ঘরদুয়ার করার আর সামর্থ্য নাই। দেশবাসী সহযোগিতা করলে হয়তো মাথা গুছার ঠাঁই হবে।’ বন্যায় সর্বস্ব হারিয়ে উৎকণ্ঠার সুরে কথাগুলো বলছিলেন, কুমিল্লার বুড়িচং উপজেলার গোমতি নদীর ভাঙন এলাকার বুরবুড়িয়া বাসিন্দা তাহমিনা বেগম।
এ এলাকার আরেক বাসিন্দা গোলাম মোস্তফার স্ত্রী বিলকিস আক্তার বলেন, ‘শুধু জানডা লইয়া রাস্তায় আছি, বন্যার পানি গেছে কিন্তু ঘরবাড়ি তো সব শেষ। এখন সড়কের উপর থাকি। মানুষ শুধু খাওন দেয়। ঘরবাড়ি না করা পর্যন্ত এখানেই থাকতে হবে। ঘর করার জন্য সরকারের সহযোগিতা চাই।’
তাঁদের মতো এমন অনেক নীরব হাহাকার চলছে বুড়িচং উপজেলার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার মানুষের মাঝে। বুড়িচং ছাড়াও জেলার আরও ১৩টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত লাখো মানুষ তাদের বাড়িঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে দিন যাপন করছে। অনেকে আশ্রয় নিয়েছে প্রতিবেশী বা স্বজনদের বাড়িতে। মাথা গোঁজার ঠাঁই কবে হবে এমন আশা ও হতাশা নিয়ে দির পার করছে তারা।
কুমিল্লায় স্মরণকালের ভয়াবহ এ বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ৮২ হাজার ঘর। কৃষি, যোগাযোগ, শিক্ষাব্যবস্থারও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সরকারি–বেসরকারি সহযোগিতা ছাড়া এসব ক্ষতি কাটিয়ে সম্ভব নয় বলে জানান ভুক্তভোগীরা। ফলে বাড়িঘর হারিয়ে খোলা আকাশের নিচে বসবাস করছেন বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত অনেক পরিবার। তবে ত্রাণ ও পুনর্বাসন কার্যালয় জানায় বরাদ্দ আসলে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করবে।
এদিকে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৩২ ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২ হাজার ৩৫০টি ঘর। লাকসাম উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১৪ হাজার ৫০ ঘর। ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫ ঘর এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৪ হাজার ৮০৫টি ঘর। বরুড়া উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৩ হাজার ৮৮৫টি ঘর। মনোহরগঞ্জ উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ হাজার ৩০০টি ঘর এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২ হাজার ৪২০টি ঘর। তিতাস উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ হাজার ৪৯টি ঘর এবং আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২৭৪টি ঘর।
দেবীদ্বার উপজেলায় সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৫ হাজার ৬২০ ঘর। লালমাইয়ে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ১ হাজার ১১২ ঘর। মুরাদনগরে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০০ ও দাউদকান্দিতে আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ২০ ঘর।
জেলায় ৮২ হাজার ৭৭৫ ঘর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে ৮ হাজার ৬৭৪টি ঘর সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্ত ও আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয় ৭৪ হাজার ৮১টি ঘর। এতে বানের পানির স্রোতে মানুষের ঘরবাড়ি ভেঙে ও বিধ্বস্ত হয়ে ক্ষতি হয়েছে ১ হাজার ৮৪ কোটি ১৪ লাখ ৫০ হাজার টাকা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বেলাল হোসেন জানান, মৎস্য খাতে ক্ষয়ক্ষতির প্রাথমিক তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সেই হিসাবে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হয়েছে।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা চন্দন কুমার পোদ্দার বলেন, জেলায় চার হাজারেরও বেশি গবাদিপশুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে দুই লাখ নয় হাজার বিভিন্ন জাতের গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বন্যার পানি নেমে গেলে সম্পূর্ণ ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।
জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মোহাম্মদ আবেদ আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘কুমিল্লায় ভয়াবহ বন্যায় ৩ হাজার ৩৬২ কোটি ১৪ লাখ ৭৩ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এর মধ্যে সম্পূর্ণ ও আংশিক মিলেয়ে ৮২ হাজার ৭৭৫টি ঘর ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছি। বরাদ্দ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পুনর্বাসনের কাজ শুরু করব।’