হাসপাতাল থেকে ছুটি পেয়ে লাল টুকটুকে জামা গায়ে ঘরে ফিরতে পারত মাগুরার সেই মেয়েটি। মা আশা করেছিলেন, এবার সুস্থ হয়ে উঠলে তাকে আর একা কোথাও যেতে দেবেন না। মেয়েকে নিয়ে আরও সতর্ক হবেন, এমনটাই ভেবেছিলেন তিনি। কিন্তু মাকে সতর্ক হওয়ার সুযোগ দিল না আট বছরের শিশুটি। লাল টুকটুকে জামার বদলে সাদা কাফনের কাপড় জড়িয়ে বাড়ি ফিরছে সে। সামাজিক অবক্ষয় আর বিচারহীনতার বলি হতে হয়েছে তাকে, এমনটাই মনে করছেন মানবাধিকারকর্মী ও সমাজবিজ্ঞানীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নেহাল করিম বলেন, ‘এটা অবশ্যই আমাদের সামাজিক অবক্ষয়। শিশু ধর্ষণ ও হত্যা হচ্ছে বিকৃত মস্তিষ্কের কারণে। সেই সঙ্গে আমাদের ঢিলেঢালা আইনি ব্যবস্থা এবং বিচারহীনতার কারণে এই ঘটনাগুলো ঘটছে। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানের সীমাবদ্ধতা আছে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় আমাদের দেশ এক কথায় সব দিক থেকে পিছিয়ে আছে। আমাদের মধ্যে মূল্যবোধের কোনো চর্চা নেই। নিয়মনীতির কোনো বালাই নেই। সৃজনশীলতার উন্মেষ নেই। এসব কারণে ধর্ষণ হচ্ছে।’
মাগুরার শিশুটিই প্রথম নয়, আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, গত আট বছরে ২৪০ শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে ৩৩ শিশুর বয়স ছয় বছরেরও কম। এসব ঘটনায় শাস্তি কার্যকরের নজির খুব কম বলে জানান মানবাধিকারকর্মীরা। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য বলছে, গত বছর ৫১৬ নারী ও কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। কিন্তু ২০২৫ সালের প্রথম দুই মাসেই ধর্ষণের সংখ্যা ৯৭ ছাড়িয়েছে।
ড. নেহাল করিম মনে করেন, কারও পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, আইনশৃঙ্খলা, তার বেড়ে ওঠা, মূল্যবোধের চর্চার ওপর নির্ভর করে সে কেমন হবে। তিনি বলেন, ‘যেসব ছেলে কো-এডুকেশনে পড়ে, তারা মেয়েদের টিজ করে না। যেসব ছেলে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে, ওইসব ছেলে সহশিক্ষা পায়নি। এখানে অনেক ফ্যাক্টর কাজ করে। এর মধ্যে তারা যেই পরিবেশে বেড়ে উঠেছে, সেটা অন্যতম।’
দেশে ধর্ষক, নির্যাতকদের ডেটাবেইস থাকা প্রয়োজন বলে মনে করেন মানবাধিকারকর্মীরা। আমরাই পারি জোটের প্রধান নির্বাহী মানবাধিকারকর্মী জিনাত আরা হক বলেন, ‘আমাদের কেস সিস্টেম এখনো ডিজিটালাইজ না। আদালতের সিস্টেমটা ডিজিটালাইজ হওয়া উচিত। উন্নত কিছু দেশে নির্যাতক বা অপরাধীর তালিকা সব আদালত ও থানায় থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে এটা হয় না বলেই অপরাধী নির্বিঘ্নে ঘুরে বেড়ায়। মাগুরার শিশুটির ক্ষেত্রে যেটা হয়েছে, ওর বোনের শ্বশুরের নামে আগেও অভিযোগ ছিল। কিন্তু এটা কেউ জানেই না হয়তো। যে অপরাধী, তার যে কয়টা পানিশমেন্ট হয়েছে, এটা সবার জানতে হবে। এটা আমাদের দেশে অনুপস্থিত। এক থানায় যে অপরাধী, আরেক থানায় গিয়ে সে একই অপরাধ করছে।’
ধর্ষণ প্রতিরোধে অভিভাবকদের সচেতন হওয়া প্রয়োজন বলে জানান ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) সমন্বয়কারী প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ সাবিনা ইয়াসমিন। তিনি বলেন, ‘আমরা আজকাল এমন কেসও পাচ্ছি, যেখানে ধর্ষক ছেলেটির বয়স ১৩-১৪ বছর। অর্থাৎ সে নিজেও শিশু। ইচ্ছেমতো ইন্টারনেট ব্যবহারের ফলে প্রাপ্তবয়স্কদের বিভিন্ন সাইটে ঢুকে হয়তো তার মধ্যে সে রকম প্রবৃত্তি হচ্ছে। অভিভাবকদের এ জন্য সচেতন হওয়া উচিত। সন্তানেরা কী করছে, কী দেখছে, কীভাবে বেড়ে উঠছে—এসব বিষয়ে বাবা-মায়ের নজর রাখা প্রয়োজন।’