নারায়ণগঞ্জের গাজী টায়ার কারখানার আগুন এখনো নেভেনি। আজ মঙ্গলবারও সেখানে আগুন জ্বলতে দেখা গেছে। বাইরে অসংখ্য মানুষ নিখোঁজ স্বজনদের অপেক্ষায় আহাজারি করছেন। ঘটনার দুদিন পেরোলেও কতজন নিখোঁজ রয়েছেন সে বিষয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি। সরকারিভাবে তালিকা না হলেও শিক্ষার্থীদের একটি দলের তালিকা অনুযায়ী, নিখোঁজ শতাধিক।
সন্ধ্যা সাড়ে ৬টা পর্যন্ত নিখোঁজ তালিকায় ১২৯ জনের নাম অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শিক্ষার্থীদের একটি দল কারখানার ভেতরে গেটের পাশে নিখোঁজদের স্বজনদের কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে এ তালিকা তৈরি করেন।
শিক্ষার্থী মাশরাফি বলেন, ‘আমরা নিখোঁজ স্বজনদের কাছ থেকে ছবিসহ তথ্য সংগ্রহ করছি। তথ্য সংগ্রহ শেষে আমরা তালিকা প্রশাসনকে দেব। তাঁরা যেন পরে তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে।’
তবে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, নিখোঁজদের সংখ্যা ৬০-৭০ জন হতে পারে। এর আগে গতকাল সোমবার ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের পরিচালক (প্রশিক্ষণ) লেফটেন্যান্ট কর্নেল রেজাউল করিম স্বজনদের বরাতে ১৬০ জন নিখোঁজের কথা জানিয়েছিলেন। তবে পরে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আমরা কোনো তালিকা করিনি, এটা প্রশাসনের দায়িত্ব।’
আজ সরেজমিন কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, নিখোঁজদের খোঁজে কারখানার গেটের সামনে ভিড় করছেন স্বজনেরা। এ সময় স্বজনদের ছবি নিয়ে আহাজারি করেন তাঁরা।
রূপগঞ্জে একটি জামদানি শাড়ির কারখানার মালিক মো. সজীব ভূঁইয়া। রোববার রাতে কারখানার দুই শ্রমিক গাজী টায়ার কারখানায় আটকা পড়লে তাঁদের উদ্ধারের জন্য আসেন। সবুজ নামের এক শ্রমিককে উদ্ধার করলেও তিনি ও অপর শ্রমিক মো. সাদ্দাম হোসেন ভবনে আটকা পড়েন।
নিখোঁজ সজীবের স্ত্রী কল্পনা আক্তার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘রাত ১০টায় আমাদের দুই শ্রমিককে উদ্ধার করতে এসে ভেতরে আটকা পড়েন আমার স্বামী। পরে তাঁর আর খোঁজ পাইনি।’
আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবনটির সামনে গিয়ে দেখা যায়, মঙ্গলবার বিকেল ৪টা পর্যন্ত ভবনটিতে কালো ধোঁয়া উড়ছে। দুই-এক জায়গায় জ্বলছে আগুনও। ধোঁয়া ও আগুন নেভাতে কাজ করছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। কারখানার প্রায় সবগুলো ভবনেই লুটপাট ও আগুনের চিহ্ন। আগুন লাগা ছয় তলা ভবনটির প্রায় সবগুলো ফ্লোরই পুড়ে গেছে। কোনো কোনো ফ্লোরের বাইরের দেয়াল খসে পড়েছে।
কারখানার আগুন নিয়ন্ত্রণে দায়িত্বে থাকা কমান্ডার ও মিরপুর ফায়ার সার্ভিস ট্রেনিং কমপ্লেক্সের ভাইস-প্রিন্সিপাল মানিকুজ্জামান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভবনটিতে টায়ার তৈরির দাহ্য পদার্থ ও কাঁচামাল ছিল। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও নির্বাপণ করা সম্ভব হয়নি। এখনো ধোঁয়া উঠছে। ভেতরেও প্রচণ্ড তাপ রয়েছে। পুরোপুরি নির্বাপণ না হওয়া পর্যন্ত ভেতরে কী অবস্থা তা বলা যাবে না। নিখোঁজদের বিষয়ে তখনই জানা যাবে।’
তবে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী বলেন, ‘তিনতলা পর্যন্ত উঠে দেখেছি। সবকিছু পুড়ে কোমর সমান ছাই হয়ে আছে। আগুন নির্বাপণের পর এগুলো সার্চ করে দেখতে হবে মরদেহ আছে কিনা।’
পুরো কারখানা ঘুরে দেখা যায়, কারখানার ভেতরে থাকা কোনো ভবনেই টায়ার বা যন্ত্রপাতি দেখা যায়নি। সবগুলো ভবনেই লুটের চিহ্ন। পুড়েছে অধিকাংশ স্থাপনা। কারখানার সামনে থাকা একটি খালেও দেখা মিলে কেরোসিনসহ বিভিন্ন তরল জাতীয় পদার্থ। সেগুলো কাপড় ও ছাঁকনি দিয়ে ড্রামে করে নিচ্ছে মানুষ।
জানা গেছে, গত রোববার হামলার আগে সকালে প্রায় দেড় শ শ্রমিক ও কর্মচারী কারখানায় কাজ করছিল। হামলার সময় তাঁরা ভয়ে কারখানা থেকে বেরিয়ে যায়।
এদিকে এই ঘটনায় নারায়ণগঞ্জ জেলার অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হামিদুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করেছে জেলা প্রশাসন।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মাহমুদুল হক বলেন, ‘শুরুতে আমাদের তথ্যটা জানানো হয়নি। আগুন লাগার পর রাত ১টার দিকে আমরা খবর পাই। শত শত মানুষ জড়ো হয়ে লুট করেছে। আমরা তদন্ত কমিটি করেছি। তদন্তে সবকিছু বেরিয়ে আসবে বলে আশা করি।’
গত রোববার বিকেলে গাজী গ্রুপের মালিক ও সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম দস্তগীর গাজীকে আদালতে তোলার খবর এলেই একদল দুর্বৃত্ত গাজীর টায়ার কারখানায় হামলা চালায় এবং লুটপাট শুরু করে।
লুটপাটের একপর্যায়ে এক পক্ষকে ভেতরে রেখে আরেক পক্ষ আগুন ধরিয়ে দেয় বলে দাবি করছেন কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী।