প্রকৃতিতে বইছে শীতের আগমনী বার্তা। সকালের শিশিরভেজা ঘাস আর হালকা কুয়াশায় প্রস্তুত হচ্ছে প্রকৃতি। একই সঙ্গে খেজুরের রস সংগ্রহে প্রস্তুত ডামুড্যা উপজেলার গাছিরাও। একসময় শরীয়তপুরের ডামুড্যা উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়নের প্রায় সব গ্রাম খেজুরগাছে ছিল ভরপুর। এখানকার খেজুরের গুড়ের অনেক সুনামও ছিল আর খেজুরের রসের ঝোলা ও পাটালি গুড় রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বাইরেও চলে যেত। গ্রামের ঘরে ঘরে খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি হতো মুড়ির মোয়া।
তাই শীত এলেই ব্যস্ত হয়ে পড়তেন গাছিরা। বিকেল হলেই গাছে হাঁড়ি বসাতেন আবার সকাল হলে রস সংগ্রহ করে বাড়ি নিয়ে আসতেন। দুপুর থেকে বিকেল পর্যন্ত চলত গুড় আর পাটালি তৈরির কাজ। ভোরে গাছিরা গাছ থেকে রস সংগ্রহ করে গ্রামগঞ্জের ছোট ছোট বাজারগুলোতে ভিড় জমাতেন। বাজার থেকে রস কিনে নানান রকমের পিঠা-পায়েস তৈরি করে স্বজনদের বাড়িতেও পাঠানো হতো। তবে বর্তমানে হারিয়ে যেতে বসেছে খেজুরগাছ।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায় ডামুড্যা উপজেলায় খেজুরগাছ কমে যাওয়ার আসল রহস্য। বেশ কয়েক বছর যাবৎ এখানে চলছে অবৈধ ইটভাটার রমরমা ব্যবসা। সেখানে প্রতিবছর হাজার হাজার খেজুরগাছ জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। নতুন নতুন আবাসন হওয়ার কারণেও ধ্বংস হচ্ছে খেজুরগাছের বাগান।
এ বিষয়ে ডামুড্যা উপজেলার বাসিন্দা আবুল কাশেম দৈনিক আজকের পত্রিকাকে বলেন, 'আমাদের বাড়িতে একসময় ২০০ খেজুরগাছ ছিল। তাতে প্রায় ৮০ থেকে ১০০ হাঁড়ি রস হতো। আমরা এই রস জ্বাল দিয়ে পাতলা গুড় তৈরি করতাম। কিন্তু আজ এই সবকিছুই আমাদের কাছে ইতিহাস। আজ আমাদের খেজুরের রস কিনে খেতে হয়। আমাদের বাড়ি ভাগাভাগির কারণে সব খেজুরগাছ কেটে ফেলতে হয়েছে।'
ডামুড্যা উপজেলা চেয়ারম্যান আলমগীর হোসেন বলেন, 'আমার নিজ গ্রাম পূর্ব ডামুড্যায় একসময় প্রায় সব বাড়িতে সকাল বেলায় তাফালে করে খেজুরের রস জ্বালাতে দেখতাম। কিছু কিছু বাড়িতে খেজুরের রস দিয়ে চা তৈরি করা হতো। এখন খেজুরের রসের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় নতুন করে অনেকেই ব্যক্তিগতভাবে খেজুরগাছ রোপণ করছেন। তাঁদের উৎসাহিত করতে পারলে দিনদিন আরও অনেক নতুন বাগান তৈরি হবে। এতে আমাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরে আসবে বলে মনে করি।'
এলাকার সূত্রে জানা যায়, ডামুড্যা উপজেলার ইসলামপুর, পূর্ব ডামুড্যা, দারুল আমান, কনেশ্বর, সিড্যা, ধানকাঠি ও শিধলকুড়া ইউনিয়নের বেশ কিছু গ্রামে কয়েকজনের উদ্যোগে গড়ে উঠেছে খেজুরের বাগান। দুই বছর ধরে তারা বাণিজ্যিকভাবে খেজুরের রস থেকে গুড় উৎপাদন শুরু করেছেন। প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে গড়ে ওঠা এই বাগানগুলো এলাকার অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে বলেও মনে করেন অনেকে।
এ বিষয়ে শিধলকুড়া ইউনিয়নের গাছি রুহুল আমিন বলেন, 'বর্তমানে যে হারে খেজুরগাছ হারিয়ে যেতে বসেছে, তাতে একসময় হয়তো আমাদের দেশে খেজুরগাছ থাকবে না। এই ঐতিহ্য ধরে রাখতে চাইলে আমাদের সবার উচিত তালগাছের মতো বেশি বেশি খেজুরগাছ লাগানো এবং তা যত্নসহকারে বড় করা।'
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শেখ আজিজুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, 'এ উপজেলায় খেজুরের গাছ রোপণের ক্ষেত্রে তেমন একটা আগ্রহ দেখা যায় না। সবাই আম, কাঁঠাল আর লিচুবাগান নিয়েই ব্যস্ত। তা ছাড়া প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষার জন্য সব গাছেরই প্রয়োজন আছে। তবে আশার দিক হচ্ছে, ইদানীং উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ব্যক্তিগত উদ্যোগে কয়েকটি ছোট ছোট খেজুরবাগান গড়ে উঠছে। খেজুর বাগান উদ্যোক্তাদের স্বাগত জানাই। তাঁদের জন্য আমার দরজা সব সময়ই খোলা।'