কালো ফলকের মাঝে সাদা রঙে লেখা কক্ষ নম্বরটা জ্বলজ্বল করছে; ১৩। মানে আনলাকি থারটিন! জনাব খান মুহম্মদ সালেক দ্বিতীয়বার তাকালেন নম্বরটির দিকে। সময়টা ১৯৬১ সালের জুন মাস। ক’বছর হলো টিচার্স ট্রেনিং কলেজ আরমানিটোলার লাল ইটের দালান ছেড়ে ধানমন্ডির নতুন ভবনে এসেছে। নতুন ভবনটি বেশ সুপরিসর, পাশেই নতুন তৈরি ঢাকা নিউ মার্কেট। সামনে দিয়ে রাস্তা চলে গেছে মিরপুর মাজারের দিকে।
আরমানিটোলায় থাকতে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ছিল দোতলাজুড়ে। আর একতলায় বসত প্রশিক্ষণের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ স্কুলটি। নতুন ভবনে আসার পর আরমানিটোলা স্কুলের বিস্তার ঘটল ঠিক, তবে ট্রেনিং কলেজ তার শিক্ষাক্রমের অপরিহার্য অংশটি হারাল। প্রস্তাব এল—ট্রেনিং কলেজ-সংলগ্ন খোলা জায়গায় নতুন স্কুল প্রতিষ্ঠার। সদরঘাটে কলেজিয়েট স্কুলের ভবন স্টেট ব্যাংকের অধিকারে যাওয়ায় ক্ষতিপূরণ হিসেবে ১১ লাখ টাকার কিছু বেশি পাওয়া গিয়েছিল। প্রথমে ওই টাকা দিয়ে নতুন স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হলো। প্রাথমিক নাম রাখা হলো কলেজিয়েট স্কুল, ধানমন্ডি।
স্কুল ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হলো। নির্মাণাধীন স্কুলের অফিস কক্ষ হিসেবে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের ১৩ নম্বর কক্ষটি বরাদ্দ দেওয়া হলো। আর এ অফিসের দায়িত্ব নিতে এলেন খান মুহম্মদ সালেক। এত দিন ছিলেন বরিশাল জিলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক; বেশ মানিয়ে নিয়েছিলেন সেখানে। পড়ানোর পাশাপাশি সাংস্কৃতিক আবহটাও তাঁর চমৎকার লাগছিল। এ সময়ই হঠাৎ জনশিক্ষা পরিচালকের টেলিগ্রাম—‘Join as Headmaster, Collegiate School, Dhanmondi, Leaving charge with Assistant Headmaster. Instruction. ’ তখনকার জনশিক্ষা পরিচালক শামসুল হক টিচার্স ট্রেনিং কলেজের অধ্যক্ষ ওসমান গনির সুপারিশে খান মুহম্মদ সালেককে নতুন স্কুলের প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিলেন।
নতুন স্কুলের প্রাথমিক নাম কলেজিয়েট স্কুল, ধানমন্ডি থাকলেও সে সিদ্ধান্ত তত দিনে বাতিল হয়েছে। উপযুক্ত নামের সন্ধান চলছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ফাইলে দেখা গেল বেশ কিছু নামের প্রস্তাব—ঢাকা স্কুল, সিটি স্কুল, মেট্রোপলিটন স্কুল, মহানগরী স্কুল, রাজধানী স্কুল, ধানমন্ডি স্কুল—এ রকম আরও কিছু নাম। এগিয়ে এলেন অধ্যক্ষ ওসমান গনি। যেহেতু টিচার্স ট্রেনিংয়ের শিক্ষাক্রম ও গবেষণায় এই স্কুল ব্যবহৃত হবে, এ স্কুলের নাম ল্যাবরেটরি স্কুল দিলে কেমন হয়! নাম চূড়ান্ত হয়ে গেল, সরকারি ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।
জনশিক্ষা পরিচালক উদ্বোধন করলেন এই স্কুল। পরদিনের ‘ইত্তেফাক’ পত্রিকায় ব্যানার হেডিং হলো, ‘মাধুর্যমণ্ডিত পরিবেশে নব বিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু।’ ‘দৈনিক আজাদ’ বিদ্যালয়ের সব কার্যক্রম পরিচালনা এবং কক্ষগুলোর নাম ফলক লেখায় বাংলা ব্যবহারের ভূয়সী প্রশংসা করল।
আনলাকি থারটিন থেকে যার যাত্রা শুরু হয়েছিল, কালক্রমে অসংখ্য সাফল্যের জন্ম দিয়ে আজ তার ৬০ বছর পূর্ণ হচ্ছে।
লেখক: অধ্যাপক, আহসানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা এবং প্রাক্তন ছাত্র, গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল।
তথ্যসূত্র:
১. ‘মানুষ গড়ার মোহন মায়ায়’, খান মুহম্মদ সালেক, মখদুমী অ্যান্ড আহসানউল্লাহ লাইব্রেরি, প্যারিদাস রোড, ঢাকা।
২. ‘Teacher's World’, Volumes 1-3, Institute of Education and Research, University of Dacca, 1961.
৩. আর্কাইভ, সংগ্রামের নোটবুক ডটকম