হোম > সারা দেশ > ঢাকা

দুই শিল্প গ্রুপেই তছরুপ ৩৫ হাজার কোটি টাকা

জয়নাল আবেদীন খান, ঢাকা 

প্রকাশ: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ০৮: ১৯
আপডেট: ০৬ জানুয়ারি ২০২৫, ১৬: ৫৭

চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের মালিকানাধীন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের বিতরণ করা মোট ঋণের পরিমাণ ৬০ হাজার ২৭২ কোটি টাকা। এর মধ্যে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকার ঋণই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় চলে গেছে। ব্যাংকের এক অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, এসব ঋণের ৩৩ হাজার ৭৯১ কোটি টাকাই বের করে নেওয়া হয়েছে চট্টগ্রাম উত্তর ও দক্ষিণ আঞ্চলিক কার্যালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন ২৪টি শাখা থেকে। এস আলম গ্রুপের স্বার্থসংশ্লিষ্ট নামী-বেনামি প্রতিষ্ঠান এই টাকা তুলে নেয়। এ ছাড়া ঢাকার কয়েকটি শাখা থেকে সিকদার গ্রুপ এবং তাদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন গ্রাহক বের করে নিয়েছে ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, এই বিপুল পরিমাণ অর্থ তছরুপের মদদদাতা ছিলেন ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ ওয়াসেক মো. আলী। এ কাজে তাঁর সহচর ছিলেন ব্যাংকের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (পদত্যাগ করা) মো. মোস্তফা খায়ের, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. মাসুদুর রহমান শাহ, চট্টগ্রাম উত্তর কার্যালয়ের তৎকালীন আঞ্চলিক প্রধান ও ইভিপি মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম দক্ষিণ কার্যালয়ের তৎকালীন আঞ্চলিক প্রধান ও ইভিপি মো. কামাল উদ্দীন, ব্যাংকের কোম্পানি সচিব অলি কামাল এফসিএ এবং এমডির পিএস মিজানুর রহমান। বিশেষভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬ শতাধিক কর্মকর্তাও এতে জড়িত ছিলেন।

ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ঋণ বিতরণে অনিয়ম তদন্তে ব্যাংকটির ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগের গঠন করা ছয়টি কমিটি গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ২২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পরিদর্শন কার্যক্রম পরিচালনা করে। পরিদর্শনে উঠে আসে, উত্তর ও দক্ষিণ চট্টগ্রামের ২৪টি শাখা থেকে ৩৩ হাজার ৭৯১ কোটি টাকার নামে-বেনামে অর্থছাড় করা হয়। মূলত ৮৯টি বাই মুরাবাহ (হাইপো) এবং ৬৯টি বাই মুরাবাহ বিনিয়োগে নিয়ম না মেনে নানা চতুরতার আশ্রয় নেওয়া হয় এসব ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে।

গত ১০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ব্যাংকের ২৭৩তম পরিচালনা পরিষদে এসব অনিয়ম নিয়ে পর্যালোচনা হয়। সেখানে ১৫৮ জন গ্রাহকের বিনিয়োগ সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ, নবায়ন, বর্ধিতকরণ, সময়বৃদ্ধির মতো অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রের গুরুতর অনিয়মগুলো হলো সীমার অতিরিক্ত বিনিয়োগ বিতরণ, সহায়ক জামানতের মূল্য বাড়িয়ে দেখানো, চতুরতার মাধ্যমে ভুল তথ্য দিয়ে বিনিয়োগ নবায়ন, বৃদ্ধিকরণ, বিনিয়োগ আদায়ে শিথিলতা, সমন্বয়ে কারচুপি এবং আইনি পদক্ষেপ এড়াতে খেলাপিকে নিয়মিত হিসাবে দেখানো। আর এই কাজে সরাসরি মদদ ছিল ব্যাংকটির এমডির।

ব্যাংকটির তদন্ত কমিটির একজন জ্যেষ্ঠ সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, চট্টগ্রামের অন্তত ২৪টি শাখায় ব্যাংকিং নিয়মাচার মানা হয়নি। ব্যাংকের এমডি সৈয়দ ওয়াসেক আলী বিশেষ তাগাদা দিয়ে গ্রাহকদের অর্থছাড় করিয়েছেন। এসব কাজ তত্ত্বাবধান করেছেন তাঁর পিএস মিজানুর রহমান। আর ব্যাংকিং নিয়মাচারবহির্ভূত আর্থিক অনিয়মের জন্য দায়ী অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক (পদত্যাগ করা) মো. মোস্তফা খায়ের, উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. মাসুদুর রহমান, চট্টগ্রাম উত্তরের তৎকালীন আঞ্চলিক প্রধান ও ইভিপি মোহাম্মদ হাফিজুর রহমান, চট্টগ্রাম দক্ষিণের তৎকালীন আঞ্চলিক প্রধান ও ইভিপি মো. কামাল উদ্দীন। তাঁরা ব্যাংকটির নিয়মবহির্ভূত ৩৩ হাজার ৭৯১ টাকার ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগের দায় কোনোভাবে এড়াতে পারেন না। তাঁদেরকে সহযোগিতা করেছেন এস আলমের আমলে নিয়োগ পরীক্ষা ছাড়া বিশেষ তদবিরে নিয়োগপ্রাপ্ত ৬ শতাধিক কর্মকর্তা।

ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইন্টারনাল কন্ট্রোল অ্যান্ড কমপ্লায়েন্স বিভাগ কর্তৃক গঠিত নিরীক্ষা দল গত ১২ ডিসেম্বর পরিচালনা পর্ষদের অডিট কমিটির কাছে সুপারিশসহ অনিয়মের বিস্তারিত তথ্য তুলে ধরে। সেখানে শাখা, অঞ্চল এবং প্রধান কার্যালয়ের সবার দায়িত্বে অবহেলার বিস্তারিত বর্ণনা এবং অপরাধ তুলে ধরে অভিযুক্তদের শাস্তির সুপারিশ করা হয়েছে। গত শনিবার অভিযুক্ত ৬ শতাধিক কর্মকর্তার চাকরিচ্যুতির প্রস্তাব তুলে ধরা হয়। কিন্তু এমডি ওয়াসেক আলী তাতে স্বাক্ষর করতে অপারগতা জানান। পরে বোর্ড তাঁকে ওই দিনই তিন মাসের জন্য ছুটিতে পাঠায়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির এমডি (এখন ছুটিতে) সৈয়দ ওয়াসেক আলী বলেন, বিনিয়োগের জন্য শাখা থেকে প্রস্তাব আসে। তা আঞ্চলিক পর্যায় থেকে প্রধান কার্যালয়ে যাচাই-বাছাই করা হয়। আর বড় বিনিয়োগের অর্থছাড়ে বোর্ডের অনুমোদন লাগে। সেখানে সবার দায়িত্ব থাকে।

অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, চট্টগ্রাম উত্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ের অধীন জুবিলী রোড শাখা গ্রাহক মেসার্স বাণিজ্য বিতান করপোরেশনসহ ২৫ গ্রাহকের কাছে নানা অনিয়মের মাধ্যমে বিপুল বিনিয়োগ করে ব্যাংক। একইভাবে আন্দরকিল্লা শাখার এহসান, হুদা এন্টারপ্রাইজসহ ১০ গ্রাহক, কদমতলী শাখার লিনিয়েজ বিজনেসসহ ১১ গ্রাহক, পাহাড়তলী শাখার হারমোনিয়াস বিজনেস হাউসসহ তিন গ্রাহক, ফতোয়াবাদ শাখার দুই গ্রাহক, খাতুনগঞ্জ শাখার ২০ গ্রাহক, হাটহাজারী শাখার তিন গ্রাহক, রাহাত্তারপুল শাখার চার গ্রাহক, হালিশহর শাখার এক গ্রাহক, বন্দরটিলা শাখার আট গ্রাহক, দোভাসী শাখার চার গ্রাহক, কুমিরা শাখার চার গ্রাহক, সদরঘাট শাখার সাত গ্রাহক এবং চকবাজার শাখার চার গ্রাহককে ব্যাপক অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করা হয়।

একই প্রতিবেদনে বলা হয়, চট্টগ্রাম দক্ষিণ আঞ্চলিক কার্যালয়ের প্রবর্তক মোড় শাখার আট গ্রাহক, বোয়ালখালী শাখার তিন গ্রাহক, মোহরা শাখার দুই গ্রাহক, আগ্রাবাদ শাখার পাঁচ গ্রাহক, চন্দনাইশ শাখার তিন গ্রাহক, পটিয়া শাখার দুই গ্রাহক, পটিয়া মহিলা শাখার তিন গ্রাহক, পাঁচলাইশ শাখার পাঁচ গ্রাহক, বহদ্দারহাট শাখার ১৫ গ্রাহককে অনিয়মের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে, যার দায় এড়াতে পারেন না ইভিপি মো. কামাল উদ্দিন।

এসব অনিয়মের বিষয়ে জানতে ব্যাংকটির কোম্পানি সচিব অলি কামালের (এফসিএ) সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘বিনিয়োগ নিয়ম মেনে হয়েছে। তবে কিছু ত্রুটি থাকতে পারে। এতে আমার সংশ্লিষ্টতা নেই।’

যোগাযোগ করা হলে ব্যাংকটির উপব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) মো. মাসুদুর রহমান শাহ বলেন, নিয়ম ছাড়া ব্যাংকে বিনিয়োগ করা যায় না। বড় বিনিয়োগ তো পর্ষদ অনুমোদন দেয়।

এ ছাড়া ছুটিতে থাকা এমডির পিএস তাঁর অনিয়মে যুক্ততার বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, ‘এ বিষয়ে এমডির কাছে জানতে চান।’ এই বলে ফোন কেটে দেন তিনি।

শুধু চট্টগ্রাম নয়, ব্যাংকটির ঢাকার বিভিন্ন শাখাতেও ঋণ বিতরণে বড় অনিয়ম হয়েছে। নথিপত্র অনুযায়ী, ব্যাংকটির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের দিলকুশা, বনানী, ধানমন্ডি, সেনানিবাস ও কারওয়ান বাজার শাখা থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নেয় সিকদার গ্রুপ এবং তার স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান। গত ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে ব্যাংকটির মোট ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ ছিল ১ হাজার ২৫ কোটি টাকা, যার দায়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ২৫৪ কোটি টাকা।

ব্যাংকটির চলতি দায়িত্বে (সিসি) এমডি আবু রেজা মো. ইয়াহিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ব্যাংকের কিছু সন্দেহভাজন শাখায় সম্পদ ঝুঁকি নিরূপণ করেছে তদন্ত দল। এটা মূলত বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় করা হয়েছে। সেখানে বিশাল অঙ্কের বিনিয়োগ ঝুঁকি হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর বিভিন্ন শাখা কর্মকর্তা, আঞ্চলিক কর্মকর্তা, প্রধান কার্যালয়ের এমডিসহ অনেকের সম্পৃক্ততা উঠে এসেছে। এসব বিষয়ে পরে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ব্যাংকে ভূরি ভূরি অনিয়ম হয়েছে। চট্টগ্রামে বেশি হয়েছে; ঢাকাতেও হয়েছে। তখনকার এমডিসহ কোনো কর্মকর্তা অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেননি। এতে ব্যাংকের অর্থ তছরুপ হয়েছে। ব্যাংকের এমন বিনিয়োগের সঙ্গে জড়িতদের চিহ্নিত করা হয়েছে। তাঁদের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই।

‘পানি পানি করে অনেকবার চিল্লাইছিল ফেলানী, পরোয়া করেনি বিএসএফ’

পিএসসিতে নাশকতাচেষ্টার অভিযোগে যুবক গ্রেপ্তার

খালেদা জিয়ার চিকিৎসা যাত্রা, বিমানবন্দরে অতিরিক্ত নিরাপত্তা জোরদার

ছাত্রলীগ নেতাসহ ২ জনকে মারধর করে পুলিশে দিল ছাত্রদল