সাবিত আল হাসান, নারায়ণগঞ্জ
গ্রামের বাকি কিশোরের মতোই প্রাণবন্ত ছিল আরাফাত হোসেন আকাশ (১৬)। স্কুল শেষে বন্ধুদের সঙ্গে ফুটবল খেলা, পুকুরে ডুবসাঁতার, বাজারের দোকানে ওয়াইফাই সংযোগ নিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে মোবাইল গেমস ছিল নিত্যদিনের রুটিন। জীবিকার তাগিদে ক’মাস আগে বাবার সঙ্গে নোয়াখালী থেকে নারায়ণগঞ্জে আসে। পরিবারের বড় ছেলে হিসেবে হাল ধরার যাত্রা শুরু করতেই শেষ হয়েছে আকাশের জীবনের পথচলা।
২১ জুলাই বেলা ১১টায় ছোট ভাই আদনান (৬) আবদার করে দোকান থেকে নাশতা এনে দিতে। ছোট ভাইয়ের আবদার পূরণে বাসা থেকে বের হয় আকাশ। নাশতার সন্ধানে মহাসড়কের কাছাকাছি আসতেই হঠাৎ মুহুর্মুহু গুলির মাঝখানে পরে সে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুটি গুলি বিদ্ধ হয় আকাশের শরীরে। চিৎকার করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আহত আকাশকে আশপাশের লোকজনের সহায়তায় উদ্ধার করে বাবা আকরাম ছুটে যান এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) হাসপাতালে নেওয়ার পথেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে আকাশ।
আকাশ নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের শিমরাইল মোড় এলাকায় বাবার সঙ্গে ফলের ব্যবসা করত। গুলিবিদ্ধও হয়েছে একই স্থানে। ঘটনার দিনই লাশ নিয়ে যাওয়া হয় নিজ গ্রাম নোয়াখালী জেলার সোনাইমুড়ি থানার ওয়াসিতপুর এলাকায়। দাফন করা হয় পারিবারিক কবরস্থানে।
আজ সোমবার দুপুরে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় নিহতের চাচাতো ভাই পাভেলের। ঘটনার বর্ণনা, পারিবারিক অবস্থান ও বর্তমান অবস্থা তুলে ধরেন।
আকাশ এসএসসি পরীক্ষার্থী ছিল ওয়াসিতপুর বহুমুখী উচ্চবিদ্যালয়ে। টেস্ট পরীক্ষায় রেজাল্ট ভালো না হওয়ায় স্কুল থেকে প্রস্তাব দেওয়া হয় ১০ হাজার টাকা দিলে অনুমতি মিলবে পরীক্ষার। কিন্তু আর্থিক অনটন থাকায় টাকা জোগাড় করা যায়নি। পরের বছর ফের পরীক্ষা দেবে এমন সিদ্ধান্ত নিয়ে চলে আসে সিদ্ধিরগঞ্জের নয়ায়াটি মুক্তিনগর এলাকায়। এখানে বাবার সঙ্গে থেকে ফলের ব্যবসা করত ফুটপাতে।
পাভেল বলেন, ‘দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে আকাশ সবার বড়। ৫-৬ মাস আগে সিদ্ধিরগঞ্জ চলে আসে। আমার চাচা আকরাম হোসেন একটি গোডাউন ভাড়া নিয়ে সেখানে ফল রাখেন এবং গোডাউনেই বসবাস করেন। এক সপ্তাহ আগে আকাশের ছোট ভাই আদনানকে ডাক্তার দেখানোর জন্য গ্রাম থেকে নিয়ে আসা হয়। এর মধ্যে পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে ওঠায় ভাইকে ডাক্তার দেখাতে পারছিল না কেউ।’
ঘটনার দিন সকালে ছোট ভাইয়ের জন্য নাশতা আনতে বের হতেই চিটাগাং রোডের খানকা মসজিদের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়। এরপর তাকে সাইন বোর্ড প্রো একটিভ হাসপাতালে নিলে বলেন তার বাম ঊরু ও মূত্রথলিতে গুলি লেগেছে। তারা সিরিয়াস রোগী রাখতে পারবে না বলে ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলে। পথে মারা যায় আকাশ। রাতেই অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে লাশ নোয়াখালীতে এনে দাফন করা হয়।
আক্ষেপ করে পাভেল বলেন, ‘আমি আর আকাশ এভাবে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব কল্পনাতেও ভাবি নাই। আকাশের মৃত্যুতে আমার চাচা-চাচি অসুস্থ হয়ে পড়ছে। আকাশ তো কোনো রাজনীতি করত না। কোনো আন্দোলনেও যায় নাই তাহলে মরতে হইলো কেন? কোন অপরাধ না কইরা গুলি খাইতে হইসে আকাশের। এলাকায় খোঁজ নিয়া দেখেন কারও সঙ্গে কখনো মারামারি করে নাই। অনেক ভালো ছিল আমার ভাইটা। এই বয়সে পরিবারের কথা চিন্তা কয়জনে করে?’