বাংলা নববর্ষকে বরণ করে নিতে ছায়ানটের প্রভাতি অনুষ্ঠান শেষে জনতার স্রোত রমনার বটমূল থেকে বেরিয়ে শাহবাগের সড়ক ধরে ছুটছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার দিকে। রমনা গেট দিয়ে বের হয়ে শাহবাগের দিকে একটু এগোতেই শেখ জামাল জাতীয় টেনিস কমপ্লেক্স। এখানে এসে এই জনস্রোত কিছুটা ভেঙে ছোটখাটো একটা জটলায় পরিণত হয়। জনা তিরিশেক মানুষ গোল হয়ে কিছু একটা করছে। দূর থেকে সেটা বোঝা গেল না। একটু মনোযোগী হয়ে তাকাতেই জটলায় থাকা মানুষজনের মাথার ওপরে আটকে গেল চোখ। মাঝখানে থাকা একজনের কাঁধে রাখা খড়ের গাদায় কয়েক শ রঙিন চরকি গাঁথা। মূলত এই চরকি ঘিরেই এমন জটলা।
এই জটলায় যেমন আছে শিশু-কিশোর, তেমন আছে নববিবাহিত দম্পতি, মাঝবয়সী ও বৃদ্ধরাও। চরকিকে ঘিরে সবারই উচ্ছ্বাস উদ্দীপনাই যেন সমান।
ছেলে, ছেলের বউ, আর নাতিসহ ছায়ানটের বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে এসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব ইমাম হোসেন। সেখান থেকেই চারুকলার দিকে যেতেই চোখ পড়ে এই চরকিগুলোর দিকে। ব্যাপক আগ্রহের সঙ্গে আট বছরের নাতি আবিরকে নিয়ে জটলা ঠেলে ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিলেন তিনি ৷ উদ্দেশ্য নাতিকে একটা চরকি কিনে দেওয়া। চরকি কেনার জন্য রীতিমতো তাঁকে ভিড় ঠেলে ঢাকার লোকাল বাসে ওঠার মতো কসরত করতে হলো।
শৈশবের স্মৃতি স্মরণ করে ইমাম হোসেন বলেন, কাঁঠাল পাতা ছিঁড়ে পাটকাঠির মাথায় লাগিয়ে বৈশাখী বাতাসে ধরলেই সেটা ঘুরতো ফিনফিন করে। দুটি খেজুরের পাতা আড়াআড়ি করে মাঝে আরেক খেজুরের পাতা দিয়ে জোড়া লাগিয়ে সেটা বাতাসে ধরলেও হতো চমৎকার চরকি। বাতাস না থাকলে এই দুই চরকি হাতে ধরে ভোঁদৌড় দিলেও ঘুরত চরকি। দৌড় যত গতিতে হতো, চরকি তত জোরে ঘুরত। এ যেন শরীরের শক্তিতে কেনা নির্মল আনন্দ।
আরও কিছু স্মৃতির ঝাঁপি খোলার আগেই ওপাশ থেকে ছেলে আর ছেলের বউয়ের তাগাদা, এবার যাওয়ার পালা। যাওয়ার আগে ইমাম বলেন, ‘আমাদের শৈশবটার সঙ্গে আমার নাতির শৈশবের কোনো মিল নেই। ওরা বেড়ে উঠছে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক পরিবেশে। তাই আমি ইচ্ছে করেই ওকে চরকি কিনে দিলাম। বাপ-দাদাদের শৈশবের কিছুটা ছোঁয়া হলেও পাক। চরকি হাতে বেশ খুশিও হয়েছে আমার নাতি। ওকে হাসতে দেখলে বড্ড ভালো লাগে।’
স্ত্রী-সন্তানসহ চারুকলায় যাচ্ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা আহসান হোসেন। কোলে থাকা সন্তানের চোখ আটকে যায় চরকিতে। চরকি পেতে মায়ের কোল থেকে ছেলের নেমে যাওয়ার চেষ্টায় চলতি পথ থেকে চরকির জটলায় আসতে বাধ্য হলেন আহসান। ছেলের জন্য চরকি কিনলেন। স্ত্রী-সন্তানসহ সেই চরকি হাতে ছবিও তুললেন।
তবে এখন আর এসবে কোনো নির্মলতা নেই, আন্তরিকতা নেই। সবকিছুকেই পুঁজি করে এক ধরনের বাণিজ্যিক আবহ বিরাজ করছে। একটা চরকির দাম ১০০ টাকা হওয়া অস্বাভাবিক উল্লেখ করে আহসান বলেন, ‘ছোট থেকে বড় সবাই উৎসবকেন্দ্রিক যে বাণিজ্যিক জাল পেতে বসে আছে, সেটা ঠিক না।’