নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর মাধবদী রেস্টহাউসের কেয়ারটেকার হাবিবুর রহমান শূন্য থেকে কোটিপতি বনে গেছেন। ভুয়া স্থায়ী ঠিকানা ও ভুয়া সনদে চাকরি নিয়ে দালালি আর অনিয়ম-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটিপতি হওয়ার অভিযোগ উঠেছে তাঁর বিরুদ্ধে। গড়ে তুলেছেন দোতলা বাড়ি, দামি মার্কেটে একাধিক দোকান, প্লট, নামে-বেনামে জমি বন্ধক, সঞ্চয় অফিসে লাখ লাখ টাকা, ব্যাংকে নিজ ও স্বজনদের নামে একাধিক ডিপিএসসহ রয়েছে সেলারি অ্যাকাউন্ট ছাড়াও বিভিন্ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট।
সম্প্রতি এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের কাছে দেওয়া লিখিত অভিযোগে এসব তথ্য উঠে এসেছে। এ ছাড়া একই অভিযোগ জমা পড়েছে বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের সচিব, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ (দুদক) সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরে। বর্তমানে অভিযোগটি তদন্ত করছে নরসিংদী পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর গঠিত কমিটি।
কেয়ারটেকার হাবিবুর রহমান নরসিংদী সদর উপজেলার নূরালাপুর ইউনিয়নের কান্দাপাড়া (পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের পাশে) এলাকার আব্দুস সামাদের ছেলে। তিনি ২১ বছর ধরে এই পদে চাকরি করছেন।
লিখিত অভিযোগ ও সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, হাবিবুর নরসিংদীর কান্দাপাড়া এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা হলেও জালিয়াতির মাধ্যমে নিজের স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লার হোমনা দেখিয়ে কেয়ারটেকার পদে স্থায়ী চাকরি নেন। অথচ তাঁর অন্য ভাইদের স্থায়ী ঠিকানা নরসিংদীর কান্দাপাড়ায়। এ ছাড়া অষ্টম শ্রেণি পাস শিক্ষাগত যোগ্যতায় নিয়েছেন জালিয়াতির আশ্রয়। যে প্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার কথা উল্লেখ করেছেন, সেখানেও নথিপত্রে নেই তাঁর নাম।
জানা গেছে, চাকরির সুবাদে দুর্নীতির চক্র গড়ে তোলেন শিল্প এলাকা মাধবদীর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিতে। কিন্তু স্থানীয় প্রভাব থাকায় এসব বিষয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। স্থানীয় পরিচয় ও মাধবদী পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশারফ হোসেন প্রধান মানিকের আত্মীয় পরিচয়ের কারণে হাবিবুরের ভয়ে সমিতির এজিএম থেকে শুরু করে সুপারভাইজার ও লাইনম্যান সবাই ভয়ে তটস্থ থাকতেন। তাঁর কথার বাইরে কাজ করলেই অন্যত্র বদলি করার ভয়ভীতিও দেখানো হতো। কেয়ারটেকার হলেও অফিসে দাপটের সঙ্গে করে বেড়ান অনিয়ম-দুর্নীতি। কেয়ারটেকার পদে কোনো যানবাহন বরাদ্দ না থাকলেও নিয়মিত পারিবারিক কাজেও ব্যবহার করেন সমিতির মোটরসাইকেল।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পল্লী বিদ্যুৎ অফিসের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী ও গ্রাহক জানান, কেয়ারটেকার পদে চাকরি হলেও হাবিব সব সময় শিল্প গ্রাহকদের দালালি নিয়ে ব্যস্ত থাকেন। নতুন সংযোগ করানোর জন্য সারা দিন এমএস বিভাগে নতুন আবেদন করা ও ইঅ্যান্ডসি বিভাগে ফাইল পাস করার জন্য ব্যস্ত থাকেন। অফিসের সিসি ক্যামেরা পরীক্ষা করলে এসবের সত্যতা পাওয়া যাবে।
এদিকে হাবিবুরের বোনজামাই জাকারিয়া একই সমিতির ওয়ার্কশপে চাকরি করেন। তাঁর মাধ্যমে ভুয়া বিল-ভাউচারে ওয়ার্কশপ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেন হাবিবুর। শিল্প গ্রাহদের ট্রান্সফরমার নষ্ট হলে তা খুলে সমিতির ওয়ার্কশপে আনা হয় এবং মেরামত করার জন্য একটি এস্টিমেট দেওয়া হয়। কিন্তু এস্টিমেট দেওয়ার আগেই জাকারিয়া তাড়াতাড়ি ট্রান্সফরমার নিতে ও মেরামত মূল্য কম করতে শিল্প গ্রাহকদের হাবিবুরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলে দেন। এভাবে দুজনে যোগসাজশ করে শিল্প গ্রাহকদের কাছে থেকে হাতিয়ে নেন লাখ লাখ টাকা। এ ছাড়া জিএস বিভাগ থেকে অবৈধভাবে ভুয়া বিল তৈরি করে অর্থ আত্মসাৎ করেন স্থানীয় প্রভাবে।
হাবিবুরের যত সম্পদ
কর্মস্থলের পাশেই রয়েছে নিজ বাড়ি। আগে যেখানে ছিল দোচালা টিনের ঘর, সেখানে এখন ছয়তলা ফাউন্ডেশন ভবনের কাজ চলমান। ইতিমধ্যে দোতলা পর্যন্ত কাজ শেষ হয়েছে। যার আনুমানিক মূল্য দেড় কোটি টাকা। এ ছাড়া সাবস্টেশনের পাশে দক্ষিণ-পূর্ব কোণে রয়েছে কোটি টাকা মূল্যের ৬ শতাংশের প্লট। শিল্পশহর মাধবদীর ১০ তলাবিশিষ্ট রাইনওকে মার্কেটের দ্বিতীয় তলায় রয়েছে প্রায় ৯০ লাখ টাকা মূল্যের দুটি দোকান। এ ছাড়া মাধবদী বাজারের সোনার বাংলা মার্কেটে রয়েছে ১ কোটি টাকা মূল্যের দুটি জুতার দোকান। কান্দাপাড়া ভাঙ্গামিল-সংলগ্ন স্থানে রয়েছে অর্ধকোটি টাকারও বেশি মূল্যের ৬ শতাংশের ১টি প্লট।
এদিকে সঞ্চয় অফিসে নিজ নামে-বেনামে জমা রয়েছে ২০ লাখ টাকা। মহিষাশুড়া ইউনিয়নের খিঁলগাও শ্বশুরবাড়িতে নামে-বেনামে রাখা হয়েছে ২০ লাখ টাকার জমি বন্ধক। বিভিন্ন ব্যাংকে নিজ ও আত্মীয়স্বজনের নামে রয়েছে একাধিক ডিপিএস।
যোগাযোগ করা হলে হাবিবুর রহমান বলেন, ‘কে বা কারা অভিযোগ দিয়েছে, জানি না। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগগুলো স্যারেরা তদন্ত করছেন। তদন্তে দোষী প্রমাণিত হলে কর্তৃপক্ষ যে শাস্তি দেবেন, তা মেনে নেব।’ অভিযোগগুলো বানোয়াট ও মিথ্যা দাবি করলেও নিজের পক্ষে কোনো তথ্য-প্রমাণ দেখানো ও সদুত্তর দিতে পারেননি তিনি।
এ বিষয়ে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি-১-এর সহকারী জেনারেল ম্যানেজার (টেকনিক্যাল) ও তদন্ত কমিটির সদস্য মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘অভিযোগকারীর নাম-ঠিকানা না থাকায় হাবিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ ও সত্যতা যাচাই করতে সময় লাগছে। সব অভিযোগের বিষয় যাচাই করে দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন জমা করার চেষ্টা করছি।’
সমিতির জ্যেষ্ঠ জেনারেল ম্যানেজার আবু বকর শিবলী বলেন, হাবিবুরের বিরুদ্ধে তদন্তকাজ চলমান রয়েছে। তদন্তে যেসব বিষয় উঠে আসবে, আমরা সেসব বিষয় ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।’