লাল-সবুজের পতাকা অর্ধনমিত। হিমেল হাওয়ায় মৃদু ওড়াউড়ি করছে দীর্ঘপথের ক্লান্ত পাখির ডানা ঝাপটানোর মতো। পাশেই শহীদ বেদি। বাহারী ফুলে বানানো বড় বড় ডালায় সেখানে শহীদ ও নিখোঁজ বুদ্ধিজীবীদের সম্মানে অনেকেই শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন, জানিয়েছেন। কেউ কেউ ভিড়-ঠেলাঠেলি উপেক্ষা করে শ্রদ্ধা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছেন পুষ্পার্ঘ্য নিয়ে। প্রথম সকাল থেকেই এমন সব আয়োজন, উদ্যোগে কলরব রায়েরবাজার বধ্যভূমি।
শ্রদ্ধা জানানোর এত আবেগ, দেশপ্রেম ও আয়োজনের মাঝেও কিছু মানুষের আবেগ, আয়োজন আড়ালে থেকে যায়। অগোচরে থাকা এমন কিছু প্রচেষ্টা নজরে এল বেলা ১১টায়। তখন সকালের হিমেল আবহ কেটে রোদের আঁচ বাড়তে শুরু করেছে। তবে কমতে শুরু করেছে শ্রদ্ধা জানাতে আসা মানুষের সংখ্যা। কিন্তু বেদি থেকে একটু সামনে সিঁড়িতে বসে কয়েকজন ছিন্নমূল শিশুকে ভাঙা কর্কশিটে নানা পদের ফুল গুঁজে ডালা বানাতে দেখা গেল। তাদের একজন নাবিলা আক্তার। পরিষ্কার গায়ের রং, মায়াবী মুখের ১০ বছরের এই শিশুর সঙ্গে কথা কথা বলার চেষ্টা।
শুরুতে রাজি না হলেও পরে কিছুটা নমনীয় হলো। জানাল, তার কাছে থাকা ফুল দিয়ে পুরো ডালাটা সাজানো যাচ্ছে না। আরও কিছু ফুল লাগবে কিন্তু কোথায় পাবে? এই নিয়ে তার দুশ্চিন্তা। নাবিলা পড়াশোনা করছে জাফরাবাদ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এই ডালা দিয়ে কী করবে? এমন প্রশ্নের জবাবে সে বলে, ‘একডু পরে এইহান থাইকা মানুষ সবডি যাইব গা। তহন আমার বানানি এই ডালা ঐহানে (বেদিতে) দিমু। কিন্তু আর ফুল নাই!’
এবার নাবিলাকে কিছুটা চিন্তামুক্ত হতে দেখা গেল। টুকটাক কথা এগোতে থাকল সাদিয়ার সঙ্গে। সাদেক খান বাজারের পাশেই তার বাসা। এই বাজারের ঢালেই ডাসডা সোসাইটি স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিল সে। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস সম্পর্কে তার ভালোই জানা-বোঝা আছে। খুব অল্প কথায় সে জানাল, ৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা অনেক বুদ্ধিজীবীদের বাসা থেকে ডেকে নিয়ে খুন করেছে। আজ তাদের স্মরণেই সবাই শ্রদ্ধা জানাতে এসেছ। এসব কোথায় জেনেছে জিজ্ঞেস করলে সাদিয়া বলে, ‘প্রত্যেক বছর এহানে এমন মানুষ আহে। ছোট বেলা থাইকাই দেখতে দেখতে জানছি।’
পাশেই দাঁড়ানো সমবয়সী রবিজা আক্তার নুপুর। নাবিলা, সাদিয়ার খেলার সঙ্গী ও স্কুলের সহপাঠী। ডালা বানানো নিয়ে তার মধ্যে বেশ আগ্রহ দেখা গেল। নুপুর বললো, ‘এইডা বানানি হইলে আমরা বেদিতে দিমু না। বেদির নিচে পানি আছে ঐহানে ভাসায়া দিমু। তাইলে ভাসতে ভাসতে ওই দেওয়ালের কাছে যাইব। আমাগো শ্রদ্ধা সবার আগে পৌঁছাইবো।’
এবারও বিচক্ষণ নেতার মতো এগিয়ে এলো সাদিয়া। নিজের ফ্রকের আড়লে রাখা কিছু ফুল দেখিয়ে আবদুল্লাহকে শান্ত করল এবং বললো, ‘এই যে আমার কাছে ফুল আছে ৷ এডি দিয়া তোরে আরেকটা বানায়া দিমু। তহন বাড়িত নিয়া যাইস। যেডি বানাইছি এডি পানিতে ভাসায়া দিমু।’ এবার লক্ষ্মী ছেলের মতো চুপটি মেরে গেলো আব্দুল্লাহ।
এদিকে নাবিলার ডালাও বানানো শেষ সাদিয়ার দেওয়া ফুল দিয়ে। এবার শুধু বেদির কাছে থাকা লোক ও পুলিশ কমার অপেক্ষা। তারপরেই অর্পণ হবে সাধ্যের সবটুকু দিয়ে বানানো শ্রদ্ধার্ঘ্য।