ফজলুল কবির
পেছন থেকে একনাগাড়ে বেজে চলছে কর্কশ হর্ন। তার সঙ্গে আরও কিছু দূর থেকে ভেসে আসা অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন যখন মিলেমিশে আক্ষরিক অর্থেই এক মাতম শুরু করেছে, তখনই পাশ থেকে হ্যাঁচ্চো। ভ্রু কুঁচকে তাকাতেই দেখা গেল মোটরসাইকেলের দুই আরোহীর একজন তাঁর মাস্ক পরা মুখটাই অভ্যাসবশত মোছার চেষ্টা করছেন। আর চালক সামনে দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা বাসটাকে পাশ কাটাতে নানা কসরত করছেন। ফুটপাতে এক পা তুলে কায়দা করে এগিয়ে যেতে চাইছেন। লক্ষ্য, বাসটা কোনোমতে পেরিয়ে সামনের খালি অংশটা চালিয়ে এগিয়ে যাওয়া। এদিকে বাসটা রাস্তার বাম পাশটা দখল করে নির্বিকার দাঁড়িয়ে যাত্রী তুলছে। তার জানালা দিয়ে গলা বের করে একজনকে বেশ মন দিয়ে শোক দিবসের পোস্টার পড়তে দেখা গেল। এদিকে একটু সামনে এগোতে চাওয়া অন্য যানবাহনের আরোহী ও চালকেরা ততক্ষণে তিতিবিরক্ত। কেউ কেউ খাঁটি বাংলা গালি দিচ্ছেন। এই বিশৃঙ্খল দশা নিয়ে চিরাচরিত মনো–দার্শনিক এবং অতি অবশ্যই রাজনৈতিক বক্তব্যও চালিয়ে যাচ্ছে অনেকে। কার উদ্দেশ্যে, কে জানে!
দৃশ্যটি গত ১১ আগস্টের এবং অতি অবশ্যই রাজধানী ঢাকার। এখন আর কোন সড়ক বা কখন, সেটি সবিস্তারে বলার প্রয়োজন নেই। করোনা মোকাবিলায় আরোপিত বিধিনিষেধ শিথিলের পর এটি এখন ঢাকার যেকোনো সড়কের চিত্র। আবার জেগে উঠেছে ঢাকা। প্রতিটি চৌরাস্তায় আবারও আগের মতো বসছে নানা যানবাহনের সমাবেশ। সেখানে কে যে কার উদ্দেশ্যে গলা (পড়ুন হর্ন) চড়াচ্ছে, কেউ জানে না। আর জানে না বলেই সবাই নিজেদের মতো করে নির্বিকার। এত এত ব্যক্তিগত গাড়ির চাপে ভিআইপি রোডগুলোও আর নিজেদের মতো একা হতে পারছে না।
উধাও গাড়ির ঢাকায় আবার যানজট ফিরেছে। একটু কি বেশিই? বোধ হয়। কারণ, লকডাউন শুরুর পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে আবার কাটাছেঁড়া শুরু হয়েছিল। তা এখনো শেষ হয়নি। কোথাও কোথাও শেষ হলেও যথাযথ সংস্কার না করায় রাস্তা সরু হয়ে গেছে। ফলে গাড়ি চলাচল করতে পারছে না ঠিকমতো।
রাজধানীর মালিবাগ রেলগেটেও রাস্তা কাটা। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ার যেখানে মগবাজার ফ্লাইওভারের ল্যান্ডিং, ঠিক সেখানেই কাটা। ফলে ফ্লাইওভারের নিচে ও এতে ওঠার জায়গাটাতে কয়েক দিন ধরেই যানজট একমাত্র বাস্তব। এর প্রভাব পড়ছে রামপুরা পর্যন্ত। রাজধানীর মিরপুর, শাহবাগ, কারওয়ানবাজার বা গুলিস্তান—সব রাস্তাতেই চলছে এমন কোনো না কোনো নির্মাণ বা সংস্কারকাজ।
এসব ভাবনায় মশগুল যখন, তখন বাস্তবে ফিরতে হলো রিকশাচালকের কথায়। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় দাঁড়িয়ে থেকে এবং বৃষ্টিহীন শ্রাবণের আর্দ্র গরমে নাকাল রিকশাচালক বেশ খেদের সঙ্গেই বললেন, ‘কয়দিন রাস্তা ফাঁকা ছিল; কাটছে আনন্দে। ভালো রাস্তা তাগো ভাল লাগে না।’ কেন—জানতে চাইলেই বেশ বিরক্তি নিয়ে পেছনে তাকিয়ে বললেন, ‘টাকা।’ সংক্ষিপ্ত উত্তর। কিন্তু ভীষণ অর্থবহ। প্রকল্পের জটিল–কুটিল হিসাব ও তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কিছু মানুষের পকেটের সম্পর্কটি মোটাদাগে আসলে সবাই বোঝেন। কিন্তু কেউ যে কেন কিছু বলে না, তা এক বিরাট ধন্দ। রাস্তায় তো সবাইকে বেশ তর্কপ্রিয় দেখা যায়।
সে যাক। জ্যামের কষ্ট ভুলতে নিঝুম ঢাকার এই আবার জেগে ওঠাকে আনন্দ মুহূর্ত হিসেবে ভাবতে চেষ্টা করা ছাড়া আর উপায় কী? এই কোলাহল দেখে আনন্দ একটু হচ্ছেও বটে।