‘আমার বড় মেয়ে শাম্মী খুব মেধাবী ছিল। ওর স্বপ্ন ছিল বিসিএস ক্যাডার হয়ে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হওয়ার। কিন্তু সব স্বপ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গেছে। সব সময় উচ্ছ্বাস-আনন্দে মেতে থাকা মেয়েটা কেন এ পথ বেছে নিল, বুঝতেছি না।’ কান্নাজড়িত কণ্ঠে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন তাঁর বাবা জাহিদুর রহমান। তিনি যশোরের কেশবপুর উপজেলার একটি ইউনিয়নের ভূমি কর্মকর্তা।
এর আগে আজ রাজধানীর পুরান ঢাকার একটি মেস থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সাবরিনা রহমান শাম্মীর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর মৃত্যুতে শোকে স্তব্ধ স্বজনেরা। একই সঙ্গে শোকের ছায়া নেমে এসেছে নিজ জেলা যশোরের চৌগাছার নারায়ণপুর গ্রাম।
২০২২ সালে শাম্মী ঢাকার কাঠেরপুলের তনুগঞ্জ লেনের ওই ছাত্রী মেসে ওঠেন। তিনি মেসের একটি কক্ষে একাই থাকতেন। আজ (রোববার) ভোর সাড়ে ৪টার দিকে স্থানীয়দের খবরে ঘটনাস্থলে গিয়ে তাঁর ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করে সূত্রাপুর থানা-পুলিশ। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে ময়নাতদন্ত শেষে রাতে চৌগাছায় পারিবারিক কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. তাজাম্মুল হক বলেন, ‘মৃত্যুর খবর পেয়ে আমরা মিটফোর্ড হাসপাতালে যাই। প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, প্রেমঘটিত কারণে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে। কারণ, পুলিশ জানিয়েছে, ফাঁস দেওয়ার সময় প্রেমিককে কলে রেখে আত্মহত্যা করেছেন এই শিক্ষার্থী। পুলিশ ইতিমধ্যে মোবাইল ফোন জব্দ করেছে।’
শাম্মীর গ্রামের কয়েকজন জানান, শাম্মীরা দুই বোন। শাম্মীর বয়স যখন ৭, তখন তাঁর মা ৪ বছরের আরেক বোনকে রেখে অন্যত্র বিয়ে করেন। কিছুদিন পর দ্বিতীয় স্বামীর সঙ্গে পারিবারিক কলহের কারণে আত্মহত্যা করেন তিনি। ছোটবেলা থেকে মা হারানো বলেই অনেক আদরের ছিলেন শাম্মী।
ছোটবেলা থেকে মেধাবী শাম্মী স্থানীয় দুটি নামকরা স্কুল ও কলেজ থেকে সাফল্যের সঙ্গে এসএসসি ও এইচএসসি পাস করে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি বিসিএস পরীক্ষারও প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। চলতি বছরের প্রথম সপ্তাহে কয়েক দিনের জন্য গ্রামে আসেন শাম্মী। তখন বলেছিলেন, এ মাসের শেষের দিকে আবার বাড়ি আসবেন।
বাবা জাহিদুর রহমান বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই মেধাবী ছিল শাম্মী। তার স্বপ্ন ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। নিজে না পড়তে পারলেও সেই স্বপ্নটা দেখতে থাকেন ছোট বোনকে ঘিরে। তাই কয়েক মাস আগে ছোট বোনকে ঢাকার ফার্মগেট এলাকার একটি কোচিং সেন্টারে নিয়ে যায়। তার পছন্দের কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে ও পাশে একটি মেসে রেখে আসে।
‘শনিবার ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। তাতে অংশ নেন তাঁর ছোট বোন। এরপর তাঁরা দুই বোন ঘোরাঘুরি করে ছোট বোনকে বাসায় রেখে আসেন। এরপর সন্ধ্যায় শাম্মীর মেসে ফেরেন। তখন তাঁর সঙ্গে শেষ কথা হয়। সে আমাকে কিছু টাকা দিতে বলে; আমি তার চাহিদা অনুযায়ী কিছু টাকাও পাঠাই। শেষ কথা বলার সময়ও শাম্মীর কথাবার্তার ভেতর কোনো পরিবর্তন লক্ষ করা যায়নি। আজ (রোববার) সকালে আমার এক ভাই জানাল, শাম্মি আর নেই।’
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘ও স্বপ্ন দেখত, বিসিএস ক্যাডার হবে। তার সেই স্বপ্ন আজ মাটিতে মিশে গেল। বাবা হলেও বন্ধুর মতো মিশতাম দুজনে। হঠাৎ কী হলো তার, যে আত্মহত্যার পথ বেঁচে নিতে হলো? গেলবার বাড়িতে এসে বলেছিল, এই সপ্তাহে আবার বাড়ি আসবে, বাড়ি সে ফিরল; তবে লাশ হয়ে।’ কোনো ছেলের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক ছিল কি না, এমন প্রশ্নের উত্তর দেননি তিনি।
স্থানীয়রা বলেন, ‘বুয়েটের এক শিক্ষার্থীর সঙ্গে শাম্মীর প্রেমের সম্পর্ক ছিল। প্রেমের অবনতি হওয়ায় আত্মহত্যা করেছে বলে শুনেছি।’ প্রতিবেশী রনি মৃধা বলেন, ‘ছোটবেলা থেকেই শাম্মী মেধাবী ছিল। এলাকায় তাকে দিয়েই আমরা উদাহরণ দিতাম। তার এই অকালমৃত্যুতে এলাকায় শোকে ছায়া নেমে এসেছে।’