রমজান এলেই বাজার অস্থিতিশীল হয়ে যায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা অতি মুনাফার জন্য সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দেয় পণ্যের দাম। এমন পরিস্থিতিতে রমজান উপলক্ষে ‘আইডিয়া-সানাবিল লস প্রজেক্ট’ নামে ব্যতিক্রমী বাজার চালু করেছে যশোরের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। এই বাজারে বাজারদরের অর্ধেক দামে মিলছে নিত্যপ্রয়োজনীয় ৯টি পণ্য।
আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যশোর শহরে এই উদ্যোগ নিয়েছে। আজ বৃহস্পতিবার দুপুরে সেই সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে দেখা গেছে, সামনের চত্বরে ৯টি পণ্যের বাজার বসিয়েছেন তরুণ স্বেচ্ছাসেবীরা। বাজারদরে পণ্য কিনে অর্ধেক বা তারও কম মূল্যে ৫৩৭টি মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের কাছে বিক্রি করছেন তাঁরা।
‘মানবকল্যাণে আমরা ঠকতে চাই’, ‘ইহলৌকিক লস সমান পারলৌকিক লাভ’—এমন স্লোগানে আজ বৃহস্পতিবার প্রথম দিনের বাজার বসে। একজন ক্রেতা-পরিবার প্রতি ৫৪ টাকা কেজি দরের চাল ২৫ টাকায় ৫ কেজি; ২৫ টাকা কেজি দরের আলু ১০ টাকা করে ২ কেজি; (বাকি সাতটি পণ্য ১ কেজি করে) ১৪০ টাকা দরের ডাল ৪০ টাকায়; ১২০ টাকা দরের চিনি ৪৫ টাকায়; ১৯০ টাকা লিটারের তেল ১২০ টাকায়; ৪৫ টাকা দরের পেঁয়াজ ২০ টাকায়; ৯৫ টাকা দরের ছোলা ৬০ টাকায়; ৬০ টাকা দরের চিড়া ২০ টাকায়; ৩২০ টাকা দরের খেজুর ১০০ টাকায় বিক্রি করা হয়।
প্রতি পরিবার সপ্তাহে একবার করে রমজানে মোট চারবার এই বাজার করার সুযোগ পাবে। বাজারদর পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সমমানের এই ৯টি পণ্য কিনতে প্রয়োজন ১ হাজার ২৮৭ টাকা, যা ৫৫০ টাকায় দিচ্ছে ‘আইডিয়া লস প্রজেক্ট’।
যশোরের আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা সহকারী অধ্যাপক হামিদুল হক শাহীন বলেন, ‘মধ্যবিত্ত দান চায় না, ত্রাণ চায় না, চায় পরিত্রাণ। আমাদের সাধ্যের মধ্যে আমরা সেই চেষ্টাই করছি। আমরা কিছু মানুষ যোগ হলেই সম্ভব বহু মানুষের পরিত্রাণের ব্যবস্থা করা। আমরা মানুষকে বোঝাতে চাচ্ছি, সব লস আসলে লস নয়। মানবসেবায় লস বরং লাভের চেয়ে বেশি কিছু। গত বছর লস প্রজেক্টের মাধ্যমে সেই তৃপ্তির স্বাদ আমরা পেয়েছি। এ বছরও তাই এই ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা।’
তিনি বলেন, নিম্নবিত্তের মানুষেরা সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন ‘ত্রাণ’ সুবিধার জন্য মানুষের কাছে হাত পাততে পারলেও চক্ষুলজ্জার খাতিরে মধ্যবিত্তকে তাদের কান্না লুকিয়ে রাখতে হয়। ‘আইডিয়া লস প্রজেক্ট’ পরোক্ষভাবে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর দাম সমাজের মধ্যবিত্ত শ্রেণির সহনশীলতার মধ্যে নিয়ে আসার একটি প্রকল্প।
জান্নাতুল ফেরদৌস আরও বলেন, ‘আমাদের অত্যন্ত ক্ষুদ্র এই প্রচেষ্টা যেন সমাজের সবার কাছে মডেল হয়। আমাদের ক্ষুদ্র প্রচেষ্টায় যদি ৫৩৭ পরিবার স্বস্তি পায়, তাহলে বিভিন্ন এলাকায় এই প্রচেষ্টা ছড়িয়ে পড়তে পারে। রমজানে বহু অসাধু ব্যবসায়ী পণ্যের দাম বাড়িয়ে মধ্যবিত্তের যে দুশ্চিন্তার কারণ হয়, তার জবাব হিসেবেই তরুণ স্বেচ্ছাসেবীদের এই আয়োজন।’
খড়কি দক্ষিণপাড়া থেকে পণ্য কিনতে আসা খন্দকার জাহাঙ্গীর বলেন, রমজানে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে চিন্তায় ছিলেন। এখানে অনেক কম টাকায় জিনিসপত্র পাওয়া যাচ্ছে। এতে শান্তিতে রোজা রাখতে পারবেন।
স্থানীয় রিকশাচালক নজরুল ইসলাম বলেন, ‘রমজান মাসে এ যেন আল্লাহর রহমত। বাজারের অর্ধেক দামে চাল, ডাল, তেল কিনে নিয়ে যাচ্ছি। রোজার কষ্ট অনেকটা আছান হবে।’
খড়কি হাজামপাড়া এলাকার বৃদ্ধা মঞ্জুরি বেগম, রেলগেট এলাকার ফাতেমা বেগমও ৫৫০ টাকা দিয়ে ৯টি পণ্য কিনে ভীষণ খুশি। তাঁরা বলেন, ‘যারা এই বাজার বসাইচে আল্লা তাগের ভালো করুক। আর রোজার মাসে যারা বেশি লোভ করে আল্লা তাগের হেদায়েত দিক। সারা দেশে এইরাম ছড়ায়ে গেলি আমাগের মতন গরিব মানষির কষ্ট কোমবে।’
আইডিয়া লস প্রজেক্টের সমন্বয়ক হারুন অর রশিদ বলেন, আইডিয়ার স্বেচ্ছাসেবীরা মাসব্যাপী জরিপ করে ৫৩৭টি পরিবারকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসে এবং তাদের মধ্যে কার্ড বিলি করে। এখন তারা মাসব্যাপী এই বাজার করতে পারবে। সত্যিই এই অনুভূতি অভূতপূর্ব।
হারুন অর রশিদ আরও বলেন, লস প্রজেক্টে বাজার করতে আসা পরিবারগুলোকে ব্যতিক্রমী অভ্যর্থনাও জানানো হয়। প্রবেশপথেই স্বেচ্ছাসেবকেরা গোলাপ ফুল দিয়ে তাঁদের স্বাগত জানিয়ে বসার ব্যবস্থা করেন। এরপর তাঁদের শরবত ও খেজুর পরিবেশন করা হয়। ধারাবাহিকভাবে বাজারের রসিদ কেটে টাকা নিয়ে পণ্য বুঝিয়ে দেওয়া হয়। এখানে এমন একটি পরিবেশ তৈরি করা হয় যে প্রত্যেক ক্রেতা যেন সম্মানের সঙ্গে তাঁদের পণ্য কিনতে পারেন।
গত বছর আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা এই বাজার চালু করে। ঈদুল ফিতরের আগে এখান থেকে ৩০০ টাকা কেজি দরে গরুর মাংস কেনা যাবে।