নাম রাকিব হোসেন। তবে পরিচিত ‘ভাইপো রাকিব’ নামে। গত দেড় দশক যশোর শহরের শংকরপুরে ত্রাস ছিলেন তিনি। ৮টি হত্যা মামলাসহ ২৫ মামলার আসামি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গা ঢাকা দিয়েছিলেন। এখন বিএনপিতে ভেড়ার চেষ্টা করছেন। এ নিয়ে এলাকার অনেকে আতঙ্কে। এরই মধ্যে গত রোববার রাতে সহযোগীদের গুলিতে আহত হয়েছেন। ফলে নতুন করে আলোচনায় এসেছেন যশোরের এই সন্ত্রাসী।
রাকিব শংকরপুর সার গোডাউন এলাকার কাজী তৌহিদুল ইসলামের ছেলে। তিন ভাই-বোনের মধ্যে রাকিব মেজ। ছিনতাই, ডাকাতি, মাদক ব্যবসা, অস্ত্র বহন ও হত্যার নানা অভিযোগে আরও ২৫টি মামলা হয় গত দেড় দশকে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তিনি স্থানীয় রেণু পোনার ব্যবসাও করেন। এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, নিজেদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখতে রাকিব এখন বিএনপিতে যোগ দেওয়ার চেষ্টা করছেন। নিজেকে বিএনপির কর্মী বলে পরিচয়ও দিচ্ছেন।
যেভাবে ভাইপো হলেন
রাকিবের স্বজন, স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, রাকিবের যেখানে বাসা, সেটি দীর্ঘদিন ধরে মাদক বেচাকেনার হট স্পট। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ যখন সরকার গঠন করে, তখন রাকিব নবম শ্রেণির ছাত্র। সেই সময় স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি গোলাম মোস্তফার সঙ্গে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। একই সঙ্গে জড়ান নানা অপরাধে। ২০১০ সালের দিকে স্থানীয় আধিপত্যের জেরে এক যুবককে কুপিয়ে জখম করেন তিনি। সেই হত্যাচেষ্টার মামলার আসামি হন। শংকরপুর সার গোডাউন এলাকায় রাকিব নামে একাধিক ব্যক্তি থাকায় ভুক্তভোগীরা বিড়ম্বনায় পড়তেন। পরে স্থানীয়রা রাকিবের নামের শেষে ‘ভাইপো’ যোগ করে দেন।
যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদারের সঙ্গে রাজনীতি করতেন রাকিব। সেই সময়ই হয়ে ওঠেন শহরের এক অংশের অপরাধজগতের একক নিয়ন্ত্রক। তবে হত্যা, ছিনতাই, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগে একসময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক হন তিনি। তবে শাহীন চাকলাদার এ সময় তাঁকে মুক্ত হতে সাহায্য করেননি। পরে তৎকালীন স্থানীয় সংসদ কাজী নাবিলের ঘনিষ্ঠরা তাঁকে মুক্ত করেন। ফলে ২০২১ সালের পর থেকে নাবিল অনুসারীদের সঙ্গে রাজনীতি করতে থাকেন। এরপর রাকিব নাবিলের অনুসারী শীর্ষ সন্ত্রাসী ও শহর যুবলীগের বহিষ্কৃত যুগ্ম আহ্বায়ক মেহবুব রহমান ওরফে ম্যানসেলের ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন। এরপর রেলগেট, শংকরপুর এলাকা নিয়ন্ত্রণে সহযোগী নয়ন, সাব্বির, আরিফদের নিয়ে নিজেই একটি ‘গ্যাং’ গড়ে তোলেন। পুলিশ বলছে, সাবেক পিপি আবু শাহরিয়ার অর্ণব, খুলনার ট্রাকচালক, হেলপার, শংকরপুরের রিপন, জুম্মানসহ ৮টি হত্যা মামলার আসামি রাকিব। একাধিক ভুক্তভোগী জানান, আওয়ামী লীগের নেতারা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন রাকিবকে। তবে এর ভুক্তভোগী হয়েছে সাধারণ মানুষ।
যশোর কোতোয়ালি থানার ওসি (তদন্ত) কাজী বাবুল বলেন, ‘রাকিব যশোরের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পুলিশের মামলার নথিপত্র জিডিটাল হয় ২০১৭ সালে। ডিজিটাল তালিকা অনুযায়ী তাঁর বিরুদ্ধে হত্যা, বিস্ফোরক, অস্ত্র, চাঁদাবাজি, হত্যাচেষ্টার ২৫টি মামলা রয়েছে। তবে অ্যানালগ মামলার নথি ঘাঁটলে এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে। সবচেয়ে হত্যা, হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক মামলা বেশি তাঁর বিরুদ্ধে। সব মামলা বিচারাধীন।’
যেভাবে গুলিবিদ্ধ
পুলিশ ও পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকায় প্রতিপক্ষ ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গ্রেপ্তার-আতঙ্কে অনেক আগে থেকেই নিজ বাড়িতে থাকতেন না রাকিব। এমনকি স্ত্রী-সন্তানও থাকছেন শ্বশুরবাড়িতে। রাকিবের বাবার বাড়িতে পারিবারিক একটা অনুষ্ঠান থাকায় রোববার দুপুরে বাড়িতে আসেন রাকিব। রাতে বাড়ি থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে বাসার সামনে দাঁড়ালে ওই এলাকার কাজী জালালের ছেলে তারেক, তারেকের ছেলে তানভীর, পশু হাসপাতাল এলাকার এস্কেন ও এস্কেনের ছেলে ইয়াসিন, আলতুর ছেলে অনিক, ইমনসহ কয়েকজন রাকিবকে লক্ষ্য করে কয়েকটি গুলি ছোড়ে। এর মধ্যে রাকিবের বুকে দুটি ও হাতে একটি গুলি লাগে।
গুলিবিদ্ধ রাকিবকে প্রথমে যশোর জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। সেখানে তাঁর অবস্থার অবনতি হলে ঢাকায় নেওয়া হয়।
রাকিবের বাবা কাজী তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘গুরুতর অবস্থায় রাকিব ঢাকায় চিকিৎসাধীন রয়েছে। তার শরীরে তিনটি গুলি অপারেশন করে বের করা হয়েছে।’
যশোর পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার নূর ই আলম সিদ্দিকী বলেন, ঢাকায় পাঠানোর আগে রাকিব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের কাছে স্থানীয় কিছু সন্ত্রাসীর নাম জানিয়েছেন। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে, আধিপত্য বিস্তারে পূর্ববিরোধের জেরে এ ঘটনা ঘটেছে। ঘটনার পর পুলিশ বিষয়টি নিয়ে তদন্ত শুরু করেছে।