নেত্রকোনায় নদ-নদীসহ হাওরাঞ্চলে ফের পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার রাত থেকে খালিয়াজুরীর ধনু নদের পানি বিপৎসীমার ৫০ সেন্টিমিটার নিচ থেকে পানি বাড়তে শুরু করে। ভারতের চেরাপুঞ্জিতে মাঝারি থেকে ভারী বৃষ্টিপাত হওয়ায় আজ রোববার দুপুর ১২টার দিকে ধনু নদের খালিয়াজুরী পয়েন্টে বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দ্বিতীয় দফায় ধনু নদের পানি বিপৎসীমার ১২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। আমরা হাওরাঞ্চলের কৃষকদের দ্রুত ধান কাটতে পরামর্শ দিচ্ছি। উজানে ভারতের চেরাপুঞ্জিতে মাঝারি থেকে প্রবল বৃষ্টিপাত হওয়ায় নদ-নদীর পানি বাড়ছে। হাওরের পাকা ধান কেটে দ্রুত ঘরে তোলার জন্য বলা হচ্ছে। অন্যদিকে পানি বাড়লে বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম রেখেছি। আমরা রাত-দিন বাঁধে অবস্থান করে বাঁধ ও ফসল রক্ষার চেষ্টা করছি।’
আগাম পূর্বাভাসের কারণে হাওরে ৬০ শতাংশ ধান কাটা হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে জেলার কৃষি বিভাগ। জেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও পাউবো পৃথকভাবে বিভিন্ন উপায়ে কৃষকদের দ্রুত পাকা ধান কাটার পরামর্শ দিচ্ছে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, এ বছর নেত্রকোনা জেলার ১০টি উপজেলায় ১ লাখ ৮৪ হাজার ৮৮৩ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছে। রোপণকৃত বোরো জমিতে ১১ লাখ ৫৬ হাজার ৫৩ মেট্রিক টন ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। গতকাল শনিবার বিকেল পর্যন্ত জেলার ৫৪ শতাংশ জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। এর মধ্যে হাওরবেষ্টিত মদন উপজেলার ৬৪ শতাংশ, মোহনগঞ্জের ৭১ শতাংশ ও খালিয়াজুরীর ৫৮ শতাংশ জমির বোরো ধান কাটা হয়েছে। দ্রুত ধান কাটার জন্য হাওরাঞ্চলের তিন উপজেলায় ২৫৫টি হারভেস্টর ও ১০ হাজার শ্রমিক দিনরাত ধান কাটার কাজে নিয়োজিত রয়েছেন।
শনিবার খালিয়াজুরী উপজেলার অধিক ঝুঁকিপূর্ণ কীর্তনখোলা ফসলরক্ষা বাঁধে গিয়ে দেখা যায়, পানি আবারও বৃদ্ধি পাওয়ায় শতাধিক শ্রমিক বাঁধ মেরামতের কাজ করছেন। এর সঙ্গে স্থানীয় কৃষক ও প্রশাসনের লোকজনও রয়েছেন।
এ সময় চাকুয়া গ্রামের কৃষক মৃদুল বিশ্বাস অভিযোগ করে বলেন, ‘সময়মতো ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ শুরু না হওয়ায় পানির চাপে ধসে যায়। বাঁধের কাছ থেকে মাটি নিয়ে বাঁধ তৈরি করায় এমন সমস্যার সৃষ্টি হয়। পানি চাপ দেওয়ায় আমরা শতাধিক কৃষক প্রায় ৩ লাখ টাকার মাটি দিয়ে বাঁধ মেরামত করেছি। হাওরের ৩০ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে। পুরো ধান কাটতে আরও ১৫ দিনের মতো সময় লাগবে। পানি বাড়ায় আমরা আবারও আতঙ্কে আছি।’
খালিয়াজুরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এইচ এম আরিফুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দেরিতে পানি নামার কারণে বাঁধের কাজ একটু দেরিতে শুরু করতে হয়। কিন্তু এ বছর আমরা যথাসময়ে ফসলরক্ষা বাঁধের কাজ সম্পন্ন করেছি। কিছু কিছু স্থানে ধস দেখা দিলেও এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা হয়নি।’
নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ এফ এম মোবারক আলী বলেন, ‘পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের দ্রুত ধান কাটার জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে হাওর এলাকায় ৫৪ শতাংশ ধান কাটা হয়েছে।’
নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত বলেন, ‘গত তিন দিন ভারতে ৫৬০ মিলিমিটারের মতো বৃষ্টি হয়েছে। ভারতের ওই পানি ধনু নদ দিয়ে নিচের দিকে প্রবাহিত হওয়ায় হাওরের পানি দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত দুই দিনে ধনু নদে ৫৬ সেন্টিমিটার পানি বেড়েছে। শনিবার বিকেল পর্যন্ত পানি বেড়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করেছে।’
মোহনলাল সৈকত বলেন, ‘ফসলরক্ষা বাঁধের এক পাশে ২০ ফুট পানি চলে এসেছে। অন্য পাশে পানি না থাকার কারণে বাঁধ হুমকিতে রয়েছে। এ জন্য বাঁধের ঝুঁকিপূর্ণ অংশগুলোতে কৃষক, প্রশাসন ও পাউবোর লোকজন সার্বক্ষণিক নজরদারি রাখছেন। ইতিমধ্যে জেলার ৫৪ শতাংশ বোরো ধান কাটা হয়েছে। আগামী সাত দিনের মধ্যে কৃষকদের শতভাগ ধান ঘরে তোলা সম্ভব হবে। আর এই সাত দিন বাঁধ টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে। আশা করছি কোনো সমস্যা হবে না।’
নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক কাজী মো. আবদুর রহমান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আধুনিক পদ্ধতিতে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের প্রতি জোর দেওয়া হয়েছে। কৃষি বিভাগের ব্যবস্থাপনায় জেলায় নতুন-পুরোনো মিলিয়ে প্রায় ১৪৫টি হারভেস্টর মেশিন দিয়ে ধান কাটা চলছে। নতুন করে আরও ১১০টি হারভেস্টর মেশিন দেওয়া হয়েছে। আশা করছি কৃষকেরা সময় মতো ধান ঘরে তুলতে পারবেন।’
গত ২ এপ্রিল সন্ধ্যায় হঠাৎ উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে খালিয়াজুরীর ধনু নদের পানি সাত-আট ফুট বেড়ে বিপৎসীমায় চলে আসে। পানির প্রবল চাপে খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার বিভিন্ন হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধগুলোতে চাপ বেড়ে যায়। ৩ ও ৪ এপ্রিল মদনের ফতেপুরতলার হাওর, খালিয়াজুরীর কীর্তনখোলা হাওর, লক্ষ্মীপুর হাওরসহ কয়েকটি হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের বাইরের অংশ তলিয়ে যায়। এতে প্রায় ৬০০ হেক্টর জমির কাঁচা বোরো ধান পানিতে ডুবে যায়। কিন্তু কৃষকেরা বলছেন, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি।
এ ছাড়া খালিয়াজুরীর লিপসা হাওর, চৈতারা হাওরসহ বিভিন্ন হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধের অন্তত ২০টি স্থান হুমকিতে পড়ে ধস ও ফাটল দেখা দেয়। পাউবো, উপজেলা প্রশাসন ও স্থানীয় কৃষকেরা তাৎক্ষণিকভাবে সম্মিলিত চেষ্টা চালিয়ে বাঁধের ক্ষতিগ্রস্ত স্থানগুলোর সংস্কারকাজ চালান। এতে এখন পর্যন্ত কোনো বাঁধ ভেঙে ফসলহানির ঘটনা ঘটেনি।