জামালপুরের বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শাকের আহমেদের বিরুদ্ধে মামলার এজাহারভুক্তসহ অজ্ঞাতনামা আসামিদের গ্রেপ্তার করে ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে।
স্থানীয়দের দাবি, বকশীগঞ্জে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই গ্রেপ্তার ও মামলা-বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন। তবে ওসি শাকের আহমেদ অভিযোগ অস্বীকার করে এটিকে কুচক্রী মহলের অপপ্রচার বলে দাবি করেছেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গতকাল বৃহস্পতিবার (২ জানুয়ারি) দুপুরে বকশীগঞ্জ উপজেলার নীলাখিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম খোকাকে নীলাখিয়া বাজারে আটকের পর ছেড়ে দিয়েছে বকশীগঞ্জ থানা-পুলিশ।
পুলিশের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সাইফুল ইসলাম খোকা বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে মামলা না থাকলেও পুলিশ থানায় নিতে চাইলে, আমি সটকে পড়ি।’
গত ২৫ ডিসেম্বর বিকেলে বকশীগঞ্জ পৌর শহরের পাখিমারা গ্রামের ছানোয়ার হোসেন ছানুকে আটকের পর থানা থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, ছানু পৌর আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি।
থানা থেকে ছাড়া পাওয়া ছানোয়ার হোসেন ছানু বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করি কি না, সেটা জিজ্ঞাসা শেষে থানা থেকে আমাকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। আমি একসময় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলাম। বর্তমানে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত নই।’
গত ১১ ডিসেম্বর বিকেলে বকশীগঞ্জ সদর ইউনিয়নের নই মিয়ার হাট থেকে বকশীগঞ্জ থানার সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মতিউর রহমান এবং এএসআই আতাউর রহমান বগারচর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সদস্য আক্রাম হোসেনকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যান।
আক্রাম হোসেন গত ১৬ নভেম্বর দায়ের করা রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানার ৪০ নম্বর একটি হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামি। এ ছাড়া তিনি মেরুরচর ইউনিয়ন বিএনপির সহসভাপতি আনিছুর রহমান বাদী হয়ে নাশকতার পরিকল্পনার অভিযোগে গত ২ অক্টোবর বকশীগঞ্জ থানায় দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত ৬৯ নম্বর আসামি।
দুটি মামলার এজাহারভুক্ত আসামি হওয়া সত্ত্বেও ওই দিন রাত ৮টার দিকে আক্রাম হোসেনকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছেন ওসি।
বকশীগঞ্জ থানার এএসআই আতাউর রহমান বলেন, ‘আক্রাম হোসেন নামে এক ব্যক্তিকে নই মিয়ার হাট থেকে আটক করে থানা আনা হয়েছিল। তবে তাঁকে কেন থানায় আনা হয়েছিল, সেটা জানি না। আমাকে এএসআই মতিউর রহমান সেখানে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল। বিষয়টি এএসআই মতিউর ভালো বলতে পারবে।’
এএসআই মতিউর রহমান বলেন, ‘বিষয়টি ওসি স্যার জানেন। স্যারের সঙ্গে যোগাযোগ করুন।’
থানা থেকে ছাড়া পাওয়া আক্রাম হোসেন বলেন, ‘থানা থেকে আমাকে পুলিশ ছেড়ে দিয়েছে। আমার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। তবে আমি নির্দোষ।’
মামলার বাদী আনিছুর রহমান বলেন, ‘আসামি আক্রাম হোসেনকে থানা থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে যোগাযোগ করলে ওসি সাহেব জানিয়েছেন, ‘‘শারীরিক অসুস্থ হওয়া তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।”’
গত ২৫ নভেম্বর পৌর শহরের চর কাউরিয়া সীমারপাড় এলাকার মৃত হাজি শেখ সাদি মাস্টারের ছেলে আওয়ামী লীগ কর্মী আবু রায়হানকে পৌর শহরের বাসস্ট্যান্ড এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে গভীর রাতে তাঁকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। আবু রায়হান গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাজধানীর উত্তর পূর্ব থানায় দায়ের করা ১০ নম্বর মামলার এজাহারভুক্ত ৪১ নম্বর আসামি। পৌর শহরের মিয়াপাড়া গ্রামের মকবুর শেখের ছেলে তোফাজ্জল হোসেন পুনো বাদী হয়ে ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে ওই মামলাটি করেন।
মামলার বাদী তোফাজ্জল হোসেন পুনো বলেন, ‘আসামি আবু রায়হানকে থানা থেকে ছেড়ে দিয়েছে পুলিশ। থানা থেকে ছাড়া পেয়ে রায়হান এলাকায় ব্যবসা করছে।’
থানা থেকে আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আসামি আবু রায়হান বলেন, ‘আমি খাইতে বসেছি। পরে কথা বলব।’ এই বলেই ফোন কেটে দেন তিনি। এরপর একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ না করায় তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
স্থানীয় বাসিন্দা আবেদ আলী, তুলন, মিজানসহ অনেকেই বলেন, ‘থানায় পুলিশের হাতে আবু রায়হানকে আটক দেখেছি। পরদিন জানতে পারি, থানা থেকে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।’
গত ১৯ ডিসেম্বর রাতে সদর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) প্যানেল চেয়ারম্যান মির্জা সোহেল পারভেজকে সূর্যনগর গ্রামে নিজ বাড়ি থেকে আটক করে পুলিশ। পরদিন ২০ ডিসেম্বর বকশীগঞ্জ থানায় নাশতার অভিযোগে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় অজ্ঞাতনামা আসামি হিসেবে গ্রেপ্তার দেখিয়ে তাঁকে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ।
প্যানেল চেয়ারম্যান মির্জা সোহেল পারভেজের মুক্তির দাবিতে নিজ বাড়িতে সংবাদ সম্মেলন ডেকে তাঁর স্ত্রী আলপনা বেগম বলেছেন, তাঁর স্বামী মির্জা সোহেল কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত নন। মামলায় উল্লেখিত ঘটনার সময় আসামিরা তাঁর স্বামীর মোটরসাইকেল ভাঙচুর করেছে। অথচ ওই মামলায় তাঁর স্বামীকেই গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
বকশীগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শাকের আহমেদ আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এখানে যোগ দেন। আগে নেত্রকোনা মডেল থানার ওসির দায়িত্বে ছিলেন।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে স্থানীয়রা বলেন, বকশীগঞ্জ থানায় যোগদানের আগে নেত্রকোনা মডেল থানার ওসির দায়িত্বে থাকাকালীন সেখানকার হাজার হাজার বিএনপি-জামায়াতের নেতা-কর্মীকে গায়েবি মামলায় হয়রানি করেছেন খন্দকার শাকের আহমেদ। এখন বকশীগঞ্জে দেদার মামলা-বাণিজ্য করে যাচ্ছেন তিনি।
বকশীগঞ্জ থানার ওসি খন্দকার শাকের আহমেদ বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ সঠিক নয়। আমার বিরুদ্ধে কুচক্রী মহল অপপ্রচার করা হচ্ছে। আইনানুযায়ী কাজ করে যাচ্ছি। আপনি থানায় এসে কথা বলুন।’
দেওয়ানগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা ইসলামপুর সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) অভিজিত দাস বলেন, ‘দায়িত্ব পালনে অনিয়মসহ গাফিলতির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকলে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষে নির্দেশনায় তদন্ত সাপেক্ষে ওসির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’