পোষ্য কোটা বাতিলের পর নতুন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে চলেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) উপাচার্য (ভিসি) অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। শিক্ষার্থীরা যে প্রক্রিয়ায় দাবি আদায় করেছেন, তা শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য ‘অপমানজনক’ বলছেন অনেকেই। এই কারণ দেখিয়ে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। পাশাপাশি ক্ষুব্ধ কর্মকর্তা, শিক্ষক ও কর্মচারীরা আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছেন। কাল রোববার থেকে কর্মবিরতি শুরু হতে পারে বলে আভাস পাওয়া গেছে।
এবার ভর্তিপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই গত ৩১ অক্টোবর পোষ্য কোটা বাতিলসহ তিন দফা দাবি জানিয়ে উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেন শিক্ষার্থীরা। এরপর পোষ্য কোটা ৪ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৩ শতাংশ করা হয়। কিন্তু শিক্ষার্থীরা তা মানেননি। ফলে ১ জানুয়ারি পোষ্য কোটা ১ শতাংশ ঘোষণা দেয় কর্তৃপক্ষ। এই কোটা শিক্ষক-কর্মকর্তার সন্তানেরা নয়, শুধু সাধারণ কর্মচারীর সন্তানেরা পাবেন বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়। কিন্তু সেটিও মানেননি শিক্ষার্থীরা।
এরপর গত বৃহস্পতিবার সকালে দুই উপ-উপাচার্যসহ প্রায় ২০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রশাসনিক ভবনের ভেতরে আটকে শিক্ষার্থীরা প্রধান ফটকে তালা দেন। দিনভর তাঁদের আটকে রাখা হয়। পরে উপাচার্য ভেতরে ঢোকেন। রাতে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনার পর তিনি ঘোষণা দেন, পোষ্য কোটা আর থাকছে না। একটা প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এটি বিলুপ্ত হবে। এরপর ফটকের তালা খুলে দিয়ে শিক্ষার্থীরা বিজয় মিছিল করেন। প্রায় ১২ ঘণ্টা পর ‘জিম্মিদশা’ থেকে মুক্তি পান প্রশাসন ভবনে আটকে পড়া শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।
পোষ্য কোটাবিরোধী এই আন্দোলনে শুরু থেকেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সমন্বয়ক সালাহউদ্দিন আম্মার। তাঁর কার্যক্রম ‘মেনে নেওয়ার মতো নয়’ উল্লেখ করে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেন্টারের পরিচালক সাইফুল ইসলাম।
অধ্যাপক সাইফুল ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি কখনোই পদলোভী নই। মাননীয় ভিসি স্যারের একান্ত ইচ্ছায় আমাকে রাবির আইসিটি সেন্টারের দায়িত্ব নিতে হয়েছে, তা-ও ভেবেচিন্তে অনেক দিন পর। পোষ্য কোটা ইস্যুকে কেন্দ্র করে গতকাল (বৃহস্পতিবার) রাবিতে যা ঘটে গেল, তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না।’ অধ্যাপক সাইফুল লিখেছেন, ‘যে কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে দাবি মানতে বাধ্য করা হলো, প্রশাসনের একজন হিসেবে এই অপমান-অপদস্থকে আমি মেনে নিতে পারছি না। আমি এর প্রতিবাদে আইসিটি পরিচালকের পদ থেকে পদত্যাগের ঘোষণা করছি।’
সপ্তাহের প্রথম কার্যদিবসে পদত্যাগপত্র প্রশাসনের কাছে পাঠিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে অধ্যাপক সাইফুল আরও লিখেছেন, ‘গত দুই মাস আম্মারের মতো গুটিকয়েক ছাত্র অব্যাহতভাবে রাবির শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও তাঁদের ফ্যামিলি নিয়ে অছাত্রসুলভ অশালীন, অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও কর্মসূচি পালন করে আসছে, তা কোনোক্রমেই মেনে নেওয়ার মতো না। আমি শিক্ষক হিসেবে এর তীব্র প্রতিবাদ করছি এবং এর ন্যায্য বিচার দাবি করছি।’
এই স্ট্যাটাসের পরিপ্রেক্ষিতে সালাহউদ্দিন আম্মার ফেসবুকে লিখেছেন, ‘আমি এমন ছাত্র যে শিক্ষকদের অপ্রিয় থেকে এমন শিক্ষাব্যবস্থা উপহার দিতে চাই, যেখানে আপনারা হাজার হাজার প্রিয় ছাত্র পেয়ে যাবেন। আমি গোলামি করা পছন্দ করি না, আর কেউ ভুল করলে তাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতেও বিন্দু পরিমাণ পিছপা হই না।’ আম্মার ওই পোস্টে আইসিটি সেন্টারের বিরুদ্ধে তাঁর ‘পার্সোনাল ডকুমেন্টস’ ফাঁস করারও অভিযোগ তোলেন।
কী ডকুমেন্টস ফাঁস করা হয়েছে, জানতে চাইলে সালাহউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘তিনি আমার ভর্তিসংক্রান্ত একটা ডকুমেন্ট ফাঁস করেছেন। এক মিটিংয়ে তিনি বলেছেন, তোমার মেরিট পজিশন ছিল ১ হাজার ৩৮৯, আইএস কোটায় ভর্তির সুযোগ পেয়েছ। আমার ওটা তো কোটা নয়। ইসলামিক স্টাডিজে ভর্তি হতে হলে ব্যাকগ্রাউন্ড মাদ্রাসা থাকলে ভালো, বিষয়টা ও রকমই ছিল।’
ভিসির সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ
ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় সম্মুখ সারিতেই ছিলেন অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। অভ্যুত্থানের পর তিনি ভিসি হন। এরপর পোষ্য কোটা ইস্যুতে সেই ‘সহযোদ্ধা ছাত্রদেরই’ বিরোধিতার মুখে পড়েন তিনি। বাধ্য হন পোষ্য কোটা বাতিলে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র বলছে, পোষ্য কোটা বহালের দাবিতে এখন আন্দোলন গড়ে তোলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন ক্ষুব্ধ শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা। আগের মতো ৫ শতাংশ পোষ্য পুনর্বহাল না করলে আগামী ৮ জানুয়ারি থেকে কর্মবিরতিতে যাওয়ার ডাক দিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় অফিসার্স সমিতি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন খান বলেন, ‘আমরাও শুনছি, শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা এক হয়ে আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এখন আমরা তাঁদের বোঝাব। এটা একটা নতুন চ্যালেঞ্জ সামনে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বলেন, ‘দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই তো নতুন নতুন চ্যালেঞ্জ ফেস করছি। আইসিটির পরিচালক পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন, আমরা তাঁকেও বোঝাচ্ছি। আসলে যে প্রক্রিয়ায় দাবি আদায় করা হয়েছে, সেটা তো গ্রহণযোগ্য নয়। আমি মর্মাহত। এখন দেখি সামনে কী হয়! যা হবে, সেটা মোকাবিলা করতে হবে।’