নাটোরের লালপুরে ছিনতাইকারী সন্দেহে চারজনকে আটক করার পর থানায় নিয়ে নির্যাতন করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ের অভিযোগ উঠেছে। অভিযোগ আমলে নিয়ে অতিরিক্ত এসপিসহ সংশ্লিষ্ট থানার পাঁচ সদস্যের বিরুদ্ধে থানায় পাল্টা মামলা করতে পুলিশ সুপারকে নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
গতকাল বৃহস্পতিবার লালপুর আমলি আদালতের জ্যেষ্ঠ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. মোসলেম উদ্দীন এ নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে আগামীকালের (১৫ জুলাই) মধ্যে আদালতে মামলার প্রতিবেদন দিতে বলা হয়।
পুলিশের ওই পাঁচ সদস্য হলেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (বড়াইগ্রাম সার্কেল এএসপি) মো. শরীফ আল রাজীব, লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. উজ্জ্বল হোসেন, উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জাহিদ হাসান, এসআই ওমর ফারুক শিমুল এবং একজন কনস্টেবল।
লালপুর আমলি আদালতের বেঞ্চ সহকারী আব্দুল্লাহ বিশ্বাস বিষয়টির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, নাটোরের লালপুর থানা-পুলিশ অভিযান চালিয়ে অজ্ঞান পার্টি ও অটোরিকশা ছিনতাইকারী চক্রের সদস্য সন্দেহে চারজনকে আটক করে। পরে মামলায় গ্রেপ্তার দেখিয়ে গত বুধবার আদালতের মাধ্যমে তাঁদের নাটোর জেলহাজতে পাঠায়।
মামলার আসামিরা হলেন পাবনার ঈশ্বরদীর ফতেহ মোহাম্মদপুর গ্রামের মো. সোহাগ (৩০), মোকাররমপুর গ্রামের মো. সালাম (৩১), নাটোরের বড়াইগ্রামের নগর গ্রামের মো. শামীম মোল্লা (২৯) ও কুষ্টিয়া সদরের বারাদি গ্রামের মো. রাকিবুল ইসলাম (৩০)।
আসামি সোহাগ হোসেনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি রেকর্ড করার জন্য মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা এসআই মো. ওমর ফারুক শিমুল আদালতে আবেদন করেন। অন্য আসামি শামীম মোল্লা, সালাম ও রাকিবুল ইসলাম রাকিবকে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠানোর জন্য উপস্থাপন করেন। এ সময় চার আসামির মধ্যে রাকিবুল ইসলাম রাকিব বাদে তিনজনই থানায় পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন।
আসামি সোহাগ হোসেন স্বেচ্ছায় ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে রাজি না হয়ে আদালতের কাছে পুলিশ হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ করেন। আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ৯ জুলাই রাত পৌনে ৯টার দিকে শ্বশুরবাড়ি উত্তর লালপুর গ্রাম থেকে লালপুর পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে রাত ৯টায় লালপুর থানায় নিয়ে যায়।
সোহাগ আরও বলেন, থানায় যাওয়ার পর ওসি মো. উজ্জ্বল হোসেন চোখ বেঁধে তাঁকে মারধর করেন। ১১ জুলাই থানা হেফাজতে থাকাকালীন রাতে ওসি তাঁর পায়ের তালুতে লাঠি দিয়ে মারেন ও অণ্ডকোষে লাথি দেন। এরপর বড়াইগ্রাম সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শরীফ আল রাজীব তাঁকে বলেন, ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে দোষ স্বীকার না করলে ওখান থেকে তাঁকে রিমান্ডে নেওয়া হবে। পরে এমন মামলা দেওয়া হবে, যাতে তিনি আর কোনো দিন বউ-বাচ্চার মুখ দেখতে না পারেন।
পরে ১২ জুলাই দুপুরে এসআই ওমর ফারুক শিমুল তাঁর পাছায় স্টিলের জিআই পাইপ দিয়ে পেটান। এরপর তাঁকে হুমকি দেওয়া হয়, আদালতে নির্যাতনের কথা বললে বিভিন্ন থানায় তাঁর নামে মামলা দেওয়া হবে এবং জামিন হলেই জেলগেট থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে।
আরেক আসামি শামীম মোল্লা অভিযোগ করেন, পুলিশ তাঁকে ১০ জুলাই রাত সাড়ে ৩টার দিকে বাড়ি থেকে তুলে মারতে মারতে থানায় নিয়ে যায়। পরদিন সকালে থানার উপরতলায় নিয়ে এসআই জাহিদ হাসান, এসআই ওমর ফারুক শিমুল ও একজন কনস্টেবল তাঁর চোখ বেঁধে টেবিলের নিচে মাথা রেখে লাঠি দিয়ে পাছায় মারধর করেন। পরে দুই পা বেঁধে পায়ের তালুতে পেটানোসহ বুকে বারবার লাথি দেওয়া হয়।
জবানবন্দি রেকর্ড করার পর গত বুধবার আসামিদের মেডিকেল পরীক্ষার জন্য পাঠাতে নাটোরের জেল সুপারকে এবং নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ককে আসামিদের শারীরিক পরীক্ষা করতে নির্দেশ দেন আদালত। পরে তাঁদের শরীরে থাকা জখমের কারণ ও জখমের সুনির্দিষ্ট বর্ণনা দিয়ে মেডিকেল সার্টিফিকেট প্রস্তুত করে গতকাল বৃহস্পতিবার (১৩ জুলাই) বিকেল ৪টার মধ্যে আদালতে উপস্থাপনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
সে অনুযায়ী গতকাল বিকেলে নাটোর সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক মো. সামিউল ইসলাম স্বাক্ষরিত আসামিদের মেডিকেল পরীক্ষার সার্টিফিকেট আদালতে দাখিল করেন নাটোর সদর হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মশিউর রহমান। চিকিৎসকের দেওয়া মেডিকেল সার্টিফিকেট পর্যালোচনা করে অভিযোগকারী তিন আসামির মধ্যে আব্দুস সালাম ও শামীম মোল্লার শরীরে নির্যাতনের প্রাথমিক সত্যতা পান আদালত। পরে নাটোরের পুলিশ সুপারকে অভিযুক্ত পাঁচ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে লালপুর থানায় মামলা করে একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে দিয়ে তদন্তের আদেশ দেওয়া হয়।
তবে লালপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. উজ্জ্বল হোসেন আসামিদের নির্যাতনের অভিযোগ অস্বীকার করেন। তিনি বলেন, পুলিশ হেফাজতে থানায় আসামি নির্যাতনের কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে নাটোরের পুলিশ সুপার মো. সাইফুর রহমান গতকাল রাতে আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘অটোরিকশা ছিনতাই মামলার আসামিদের ধরতে গেলে তাঁরা দৌড়ে পালানোর চেষ্টা করেন। এ সময় পড়ে গিয়ে তাঁরা শরীরে আঘাত পেয়ে থাকতে পারেন। কিন্তু আসামিরা পরে আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগ করেছেন। এ-সংক্রান্ত আদালতের আদেশের কথা শুনেছি, তবে এখনো আদেশের কপি পাইনি। আদেশের কপি পেলে সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’