গ্রামাঞ্চলের নদী-নালা, খাল-বিলে প্রায়ই চোখে পড়ে কচুরিপানা। কচুরিপানার ফুল দেখতে সুন্দর হলেও, কচুরিপানা তেমন কোনো কাজে আসে না। তবে এবার সেই ফেলনা কচুরিপানা থেকে পাবনায় তৈরি হচ্ছে হস্তশিল্পের নজরকাড়া নানারকম পণ্য।
পরিবেশবান্ধব ও দামে কম হওয়ায়, এসব পণ্যের চাহিদা বাড়ছে দেশ-বিদেশে। বর্তমানে জেলা থেকে তৈরি কচুরিপানার এসব পণ্য ইউরোপ, আমেরিকার অন্তত আটটি দেশে রপ্তানি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন উদ্যোক্তারা।
তাঁদের দাবি, এতে বছরে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা আয় হয়। একই সঙ্গে কচুরিপানা ঘিরে পাবনায় বাড়ছে কর্মসংস্থান।
তিন বছর আগে জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ক্ষেতুপাড়া ইউনিয়নের রসুলপুর গ্রামের জয়তুন খাতুন ও রফিকুল ইসলাম দম্পতির উদ্যোগে গড়ে উঠেছে কচুরিপানার এমনই এক কুটিরশিল্প। এখানে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে কচুরিপানা কেনা-বেচা ও পণ্য উৎপাদন। কচুরিপানা থেকে টব, ফুলদানি, ফল ঝুড়ি, ডিম রাখার পাত্র, পাপোশ, মোড়া, টুপি, আয়নার ফ্রেম, ডাইনিং টেবিলের ম্যাটসহ দশ রকমের পণ্য তৈরি হচ্ছে এখানে।
শ্রমিকেরা জানান, বিভিন্ন আকারের হস্তশিল্প পণ্য তৈরি করে প্রকারভেদে ৪০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত মজুরি পান। এসব পণ্য কেউ কারখানায় বসে তৈরি করেন; আবার কেউ বাড়িতে বসে কাজ করে সেগুলো কারখানায় জমা দেন। এ ছাড়া কচুরিপানা পরিবহন ও শুকানোর কাজ থেকে শ্রমিকেরা গড়ে দিনে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করেন।
আলাপকালে জয়তুন খাতুন বলেন, ‘আমার শ্বশুর বেতের ব্যবসা করতেন। একপর্যায়ে আমার স্বামীও ব্যবসা শুরু করেন। এরপর তিন বছর আগে বেতের জিনিসপত্র ক্রয় করা সম্পর্কে জানতে স্বামীর সঙ্গে ঢাকায় বিডি ক্রিয়েশনে যাই। সেখানে গিয়ে দেখি কচুরিপানা দিয়ে নানান পণ্য তৈরি করছে। সেখান থেকে উৎসাহ নিই।’
রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অর্থাভাবে বড় পরিসরে পণ্য তৈরির কাজ করতে পারছি না। কারণ কোম্পানি থেকে অর্ডার নিয়ে এসে নিজেকে অর্থ লগ্নি করে কাজগুলো তুলতে হয়। সে ক্ষেত্রে এনজিও থেকে যে ঋণ নেই সেটার অনেক সুদ বহন করতে হয়। খুব একটা লাভ থাকে না। সরকার যদি অল্প সুদে ঋণ দেয় তাহলে এই কাজে গ্রামের অন্তত ২ হাজার নারীকে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারব।’
এদিকে কচুরিপানা বিক্রি ও পণ্য তৈরির কাজ করে অনেকেই সংসারে সচ্ছলতা এনেছেন। স্কুল-কলেজ অনেক ছাত্রীও এ কাজ করে নিজেদের পড়াশোনা ও হাত খরচ চালিয়ে নিতে পারছেন।
সাঁথিয়ার মিয়াপুর গ্রামের নাজমুল মিয়া, বানিয়াবছ গ্রামের মজিবুর রহমান ও ধাতালপুর গ্রামের ইন্তাজ আলী জানান, প্রতিদিন ৮০০ থেকে ১ হাজার ২০০ টাকার কচুরিপানা বিক্রি করেন তাঁরা।
রসুলপুর গ্রামের মাজিয়া খাতুন, আকলিমা বেগম ও গঙ্গারামপুর গ্রামের ডলি খাতুন জানান, সংসারের কাজ শেষ করে তাঁরা এ কাজ করেন। এতে সপ্তাহে ১ হাজার ২০০ টাকা থেকে ১ হাজার ৫০০ টাকা আয় করতে পারেন। আগের থেকে বর্তমানে সংসারে সচ্ছলতা এসেছে তাঁদের।
সাঁথিয়া উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা আলমগীর হোসেন বলেন, ‘ওই দম্পতি আমাদের কাছে আবেদন করলে তাঁদের শতকরা আড়াই ভাগ সার্ভিস চার্জে ঋণ দিতে পারব। একই সঙ্গে এই কুটিরশিল্পকে ঘিরে একটি প্রকল্প প্রস্তাবনা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। যাতে গ্রামের আরও বেশি নারীকে এই কাজে সম্পৃক্ত করা যায়।’
বিডি ক্রিয়েশনের জ্যৈষ্ঠ ব্যবস্থাপক (অপারেশন) মাহবুব আলম বলেন, ২০২০ সাল থেকে আমরা কচুরিপানা দিয়ে হস্তশিল্প পণ্য তৈরির কাজ শুরু করি। ওই বছরের শেষের দিকে সাঁথিয়া জয়তুন-রফিকুল দম্পতি আমাদের সঙ্গে কাজ করছে।
বিডি ক্রিয়েশনের কর্ণধার আব্দুর রহমান আশিক বলেন, শুকনো কচুরিপানা কিনে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে তাঁরা বাহারি সব পণ্য তৈরি করেন। আটটি দেশে কচুরিপানার তৈরি পণ্য রপ্তানি হচ্ছে। আরও কয়েকটি দেশের সঙ্গে আলোচনা চলছে। প্রতি বছর পরিবেশবান্ধব হস্তশিল্প পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দেড় থেকে দুই কোটি টাকা আয় হচ্ছে।