চাকরির জন্য দালালের খপ্পরে পড়ে রাশিয়া গিয়ে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধে নিহত হয়েছেন নাটোরের সিংড়ার যুবক হুমায়ুন কবির (৩৩)। গত ২৬ জানুয়ারি ড্রোন হামলায় মৃত্যু হয় হুমায়ুন কবিরের। স্বামী হারিয়ে এক বছরের মেয়ে প্রীতিকে নিয়ে যেন অন্ধকার দেখছেন হুমায়ুনের স্ত্রী তারা বেগম।
নিহত হুমায়ুনের দুলাভাই রহমত আলীকেও (৪৬) বাধ্য করা হয়েছে ওই যুদ্ধে অংশ নিতে। নামমাত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে তাঁদের যুদ্ধে যেতে হয়েছে। রহমত আলী এখন বন্দী আছেন রাশিয়ান সেনাক্যাম্পে। স্বজনদের কাছে প্রাণে বাঁচার আকুতি জানিয়েছেন তিনি।
সিংড়ার হুলহুলিয়া গ্রামের ওই দুই পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সংসারে সচ্ছলতা আর সন্তানদের ভবিষ্যতের কথা ভেবে হুমায়ুন ও রহমত বিদেশ যান। প্রথমে ওমরাহ ভিসায় তাঁদের সৌদি আরব, এরপর ট্যুরিস্ট ভিসায় রাশিয়ায় নেওয়া হয়। সেখানে পৌঁছানোর পর তাঁদের বাধ্য করা হয় যুদ্ধে অংশ নিতে।
গত মাসের ২০ তারিখ হুমায়ুন ও রহমত ফোনে স্বজনদের এসব তথ্য জানান। পরে ২৬ জানুয়ারি রহমত ফোনে হুমায়ুনের মৃত্যুর কথা জানান।
স্বজনেরা জানান, ২০২৪ সালের ২৮ অক্টোবর ড্রিম হোম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড নামের ঢাকার একটি কোম্পানির মাধ্যমে হুমায়ুন ও রহমত পাড়ি জমিয়েছিলেন রাশিয়ায়। প্রতিমাসে আড়াই লাখ টাকা বেতন পাবেন; দালালদের এমন প্রলোভনে সংসারে সচ্ছলতা ফেরানোর আশায় জমিজমা, স্ত্রীর গহনা বিক্রি এবং উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে তাঁরা দেশ ছাড়েন। সেখানে পৌঁছানোর পর বেশ কিছুদিন তাঁদের কোনো খোঁজ ছিল না। কিছুদিন আগে পরিবারের সদস্যরা জানতে পারেন তাঁদের বর্তমান দুর্গতির খবর।
হুমায়ুনের স্ত্রী তারা বেগম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমি এখন কী করব? এই সন্তানের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে হুমায়ুন বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে, সে তো আর ফিরল না। এখন যে টাকা ঋণ এবং জমিজমা বিক্রি করে বিদেশে গিয়েছে, সেই টাকা শোধ করব কী করে? দালালরা আমাদের কাছ থেকে ১৮ লাখ টাকা নিয়েছেন। কথা ছিল তারা রাশিয়ায় চাকরি করে এই টাকা খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই পরিশোধ করতে পারবে।’
দালালদের দ্রুত গ্রেপ্তার করে কঠোর শাস্তির দাবি জানিয়ে তারা বেগম বলেন, ‘আমি সরকারের কাছে দাবি করছি, যেন আমার স্বামীর লাশ দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হয় এবং ননদের জামাইকে দেশে ফিরিয়ে আনা হোক।’
রহমত আলীর স্ত্রী আফরোজা বেগম বলেন, ‘হাসান নামের এক দালালের মাধ্যমে সাইপ্রাস যাওয়ার কথা হয় আমার স্বামী ও ভাইয়ের। কিন্তু তিনি সাইপ্রাসের ভিসা না দিয়ে বলেছেন রাশিয়া নিয়ে যাবেন। এর জন্য সৌদি আরবে গিয়ে দুই মাস থাকতে হবে, ওমরাহ করতে হবে। সেখান থেকে তাঁদের রাশিয়ার ভিসা দেবেন। আড়াই লাখ টাকার বেতনের প্রলোভন দেখিয়ে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। কিন্তু রাশিয়া পৌঁছানোর পর সেখানকার দালাল তাঁদের বিক্রি করে দেন। এরপর সেখানে ট্রেনিং করিয়ে জোরপূর্বক যুদ্ধে নিয়ে যাওয়া হয়।’
আফরোজা আরও বলেন, ‘সেখানে যুদ্ধে আমার একমাত্র ভাই মারা গেছে। আমার স্বামীর হাতের ওপরেই মারা গেছে। আমার স্বামী ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করে বলে, “আমাকে বাঁচাও। ” আমরা এখন কী করব? কার কাছে বলব, কিছু বুঝতে পারছি না।’
হুমায়ুন কবিরের মা কারিমুন বেগম বলেন, ‘আমার ছেলে তো মারাই গেছে, এখন জামাইটা যেন ফিরে আসে। ছেলের লাশটা যেন ফিরে পাই, সরকারের কাছে সেই দাবি জানাই। আমরা নিঃস্ব হয়ে গেলাম।’
হুমায়ুনের বন্ধু মাহমুদ হাসান জানান, দালালের খপ্পরে পড়ে পরিবারটি সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে। স্থানীয় সাখাওয়াত হোসেনের মাধ্যমেই তাঁরা এইভাবে বিদেশে পাড়ি জামান চাকরির জন্য। সাখাওয়াত বর্তমানে সাইপ্রাসে আছেন।
এ বিষয়ে কথা বলতে স্থানীয় দালালদের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তা বন্ধ পাওয়া গেছে। আর ঢাকার ড্রিম হোম ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরস লিমিটেড কোম্পানির দেওয়া ফোন নম্বরে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
সিংড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মাজহারুল ইসলাম বলেন, ভুক্তভোগী পরিবারের কেউ এখন পর্যন্ত আমাকে মৌখিক বা লিখিতভাবে বিষয়টি জানায়নি। তাঁরা খুব সম্ভবত এজেন্সির সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। তাঁরা বিস্তারিত জানালে আমি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করব।’