‘আবারও বন্যায় ভেসে যাচ্ছে চরের মানুষ ও ফসলি জমি। নেই কোন সাংবাদিক, নেই কোন টিভি চ্যানেল, নেই ইউনিয়ন পরিষদ সদস্যদের কোন খবর।’ এলাকার বন্যা ও নদী ভাঙন পরিস্থিতি নিয়ে হতাশা থেকে গতকাল বুধবার সকালে ফেসবুকে এমন স্ট্যাটাস দেন রাজশাহীর চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের বাসিন্দা মহিউদ্দিন মিঠু।
পদ্মা নদীর ডান তীরে ভারতীয় সীমান্ত লাগোয়া এই চরের কয়েকটি গ্রামে ভাঙন দেখা দিয়েছে এক সপ্তাহ ধরে। ভাঙন চলছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাকা এবং নারায়ণপুর এলাকায়ও। চাঁপাইনবাবগঞ্জেই পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে প্রায় ছয় হাজার পরিবার। তলিয়ে গেছে নাটোরের লালপুর উপজেলার কয়েক হাজার বিঘা ফসলি জমি। রাজশাহী-চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরের বাসিন্দাদের অনেকেই এখন ভাঙন আতঙ্কে ঘরবাড়ি সরিয়ে নিচ্ছেন।
কেউ কেউ সবকিছু নৌকায় তুলে চলে আসছে এই পারে। খুঁজছে বসবাসের নতুন ঠিকানা। আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার রেলবাজার ঘাটে এমনই কয়েকটি নৌকা এসে ভেড়ে। নৌকাগুলোর কোনোটিতে গরু-ছাগল, কোনোটিতে বস্তায় বস্তায় ধান আবার কোনোটিতে চর থেকে ভেঙে নিয়ে আসা বাড়ির চাল, টিনের ছাউনি ও আসবাবপত্র।
এসব নৌকায় আসে চর আষাড়িয়াদহ ইউনিয়নের চর বয়ারমারি গ্রামের আসগর আলীর পরিবার। আসগর আলী বলেন, প্রতিবছরই তাঁদের গ্রাম পদ্মায় ভাঙে। এরই মধ্যে ১৫ বিঘা কৃষিজমি হারিয়েছেন তিনি। বাড়ি সরিয়েছেন ছয়বার। এবারও নদীর ভাঙন বাড়ির কাছে চলে আসার কারণে তাঁরা চলে এলেন এ পারে। মাছমারা গ্রামে আশ্রয় নেবেন তাঁরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আলাতুলি ও নারায়ণপুর ইউনিয়নের প্রায় চার কিলোমিটার এলাকাজুড়ে তীব্র ভাঙন দেখা দিয়েছে। আগের বছরও এই এলাকার দুই শতাধিক বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। এরই মধ্যে ইউনিয়নের এক-তৃতীয়াংশ কৃষিজমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এবারও ভাঙনে হুমকির মুখে পড়েছে বাড়িঘর, বাজারসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। শিবগঞ্জ উপজেলার পাকা ইউনিয়নেও চলছে পদ্মা নদীর ভাঙন। এই এলাকার অনেকেই আতঙ্কে বাড়িঘর সরিয়ে নিচ্ছেন। শিবগঞ্জের পাকা ইউনিয়নে প্রায় ২৫০, দুর্লভপুর ইউনিয়নে ৪ হাজার ৫০০ ও মনাকষা ইউনিয়নে প্রায় ৩৫০টি পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের নারায়ণপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নাজির হোসেন বলেন, ‘২০১৮ সাল থেকেই এই ইউনিয়ন ভাঙছে। এবারও তীব্র ভাঙন চলছে। ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ও হুমকির মুখে। নদীর তীররক্ষায় বিভিন্ন দপ্তরে ছোটাছুটি করেও সাড়া পাওয়া যায়নি।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মাহবুব-উল-ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন মাধ্যমে শোনা যাচ্ছে যে প্রায় ছয় হাজার মানুষ পানিবন্দী অবস্থায় আছে। এটা যাচাই-বাছাই করে প্রকৃত তালিকা করার জন্য সদর ও শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বলা হয়েছে। তালিকাটা চূড়ান্ত হলেই আমরা পানিবন্দী মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ শুরু করব।’
রাজশাহী বিভাগীয় কৃষি দপ্তরের হিসাবে, নাটোরের লালপুর উপজেলায় প্রায় সাড়ে ৩ হাজার বিঘা জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এ ছাড়া রাজশাহীর ৯ হাজার ৬৮১ বিঘা ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের ১৪ হাজার ৮৫৭ বিঘা ফসলি জমি প্লাবিত হয়েছে। লালপুরের বিলমাড়িয়া ইউনিয়নের নওশারা সুলতানপুর, চাকলা বিনোদপুর, দিয়াড়শংকরপুর, আরাজি বাকনাই, রসুলপুর ও মোহরকয়া আংশিকসহ প্রায় ১৮টি চর এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে গত এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বেড়েছে। আজ বৃহস্পতিবার সকালে পানি কিছুটা কমেছে। পদ্মার প্রবেশদ্বার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে আজ ভোর ৬টায় পদ্মার পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ২১ দশমিক ৫ মিটার। সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা এক সেন্টিমিটার কম পাওয়া যায়। এ পয়েন্টে পানির বিপৎসীমা ২২ দশমিক ০৫ মিটার।
রাজশাহীর বড়কুঠি পয়েন্টে পদ্মার বিপৎসীমা ১৮ দশমিক ০৫ মিটার। আজ বৃহস্পতিবার ভোর ৬টা ও সকাল ৯টায় পানির উচ্চতা ছিল ১৬ দশমিক ৮৯ মিটার। পাবনার ঈশ্বরদীর পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পয়েন্টে এ দিন ভোর ৬টা ও সকাল ৯টায় পদ্মা নদীর পানির উচ্চতা পাওয়া গেছে ১২ দশমিক ৩৮ মিটার। এখানে পদ্মার পানির বিপৎসীমা ১৪ দশমিক ২৫ মিটার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) উত্তরাঞ্চলীয় পানিবিজ্ঞান পরিমাপ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘গত এক সপ্তাহ ধরে পদ্মার পানি বেড়েছে। তবে বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। এর মধ্যেই আজ বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের পাংখা পয়েন্টে পানি কমেছে। ফলে ভাটিতেও পানি কমবে। পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী পাঁচ দিন পানি কমতে পারে।’