১৯৭১ সালে এ দেশের নানা প্রান্তে পাকিস্তানি সেনাদের চালানো হত্যাযজ্ঞের মধ্যে একটি হলো রাজশাহী জেলার পুঠিয়া উপজেলা। পুঠিয়া উপজেলার মাইপাড়া গ্রামজুড়ে বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত চালায় তাণ্ডব। সেই তারিখটি ছিল ১২ এপ্রিল।
আজ পুঠিয়ার মাইপাড়া গণহত্যা দিবস। মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর থেকে এই এলাকায় দিবসটি ছোট পরিসরে পালিত হয়ে আসছে।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা ও প্রবীণদের তথ্য অনুযায়ী, এ দিনে প্রায় ২৮০-৩০০ জন সাধারণ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়েছিলেন। তবে বিড়ালদহ এলাকায় নির্মিত মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে ১১৮ জনের নামের তালিকা রয়েছে। শহীদদের মধ্যে অধিকাংশ ছিলেন বহিরাগত ও অপরিচিত। আর পাকিস্তানি সেনারা অনেক শহীদের লাশ একত্রে অগ্নিসংযোগ করে পুড়িয়ে দেয়। যার কারণে সকলের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। এদিকে স্বাধীনতার ৫২ বছর পূর্ণ হলেও উপজেলার বিহারিপাড়ার সেই গণকবরটি আজও জরাজীর্ণ ও অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে আছে।
১২ এপ্রিল ঘটে যাওয়া হত্যাযজ্ঞের বিষয় উল্লেখ করে বানেশ্বর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজি সুলতান আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই দিন ছোট বাচ্চা থেকে বৃদ্ধ পর্যন্ত কেউ পাকবাহিনীর হাত থেকে রেহাই পায়নি। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে মানুষের বাড়িঘর, গরু-ছাগল। এলাকায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে ছিল শত শত মানুষের লাশ। কয়েক দিন পর্যন্ত ওই শহীদদের লাশগুলো শেয়াল-কুকুরে খেয়েছে। আবার কোথাও কোথাও লাশের স্তূপে পাকবাহিনীরা ডিজেল-পেট্রল ঢেলে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে।
বীর মুক্তিযোদ্ধা গাজি সুলতান আরও বলেন, স্বাধীনতার ৫২ বছর হয়ে গেল কিন্তু বিহারিপাড়া এলাকায় গণকবরটির আজও সঠিক মূল্যায়ন করা হয়নি। তবে এটা সম্মানের যে বিড়ালদহ গণহত্যায় শহীদদের নামে মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
স্থানীয় প্রবীণ ব্যক্তি ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি কাজি মুক্তাদির শরিফ (৬৮) বলেন, ‘১৯৭১ সালে আমার বয়স ১৪ বছর। সে সময় আমি অষ্টম শ্রেণিতে পড়াশোনা করি। ১২ এপ্রিল ঠিক দুপুর ১২টার দিকে সাজোঁয়াযানসহ পাকসেনারা মাইপাড়ায় অবস্থান নেয়। স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় বেলা ২টার দিকে মাইপাড়া লোহার ব্রিজের কাছ থেকে হত্যাযজ্ঞ চালানো শুরু করে। বৃষ্টির মতো গুলি আর মর্টার শেলের আঘাতে স্তব্ধ হয়ে যায় আশপাশের কয়েকটি গ্রাম। মুহূর্তের মধ্যে অগ্নিকাণ্ডের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায়। চারদিকে মানুষ, গরু-ছাগল পোড়া গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে। এলাকার লোকজন এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করে পালিয়ে আত্মরক্ষা করেছেন।’
১৯৭১ সালের ওই দিনে ঘটে যাওয়া ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ছায়দুল ইসলাম (৭২) নামে মাইপাড়া গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘১২ এপ্রিল আমাদের মাইপাড়া গ্রামের জন্য একটি মর্মান্তিক দিন ছিল। ওই গ্রামে দেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী চারদিক থেকে ঘিরে ফেলে। সেদিন গুলি ও শেলের আঘাতের কাছে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হন। আর পাকবাহিনী এলাকাজুড়ে গণহত্যা আর অগ্নিসংযোগ চালিয়েছে। সেদিন তাদের হাত থেকে পশু-পাখিও রেহাই পায়নি। বাতাসে চারদিকে শুধু পোড়া লাশের দুর্গন্ধ ভেসে আসে। ঘটনার দুদিন পর বেঁচে থাকা লোকজন এলাকায় আসতে শুরু করেন। তাঁরা নিজেদের পরিচিত শহীদদের শনাক্ত করে পারিবারিক গোরস্থানে দাফন করেছেন। আবার অনেকের চেহারা বীভৎস হওয়ায় তাঁদের পরিচয় শনাক্ত করা যায়নি। সে কারণে তাদের একত্রিত করে বিভিন্ন জঙ্গলের ফাঁকা স্থানে মাটিতে পুঁতে রাখা হয়েছিল।’
ছায়দুল ইসলাম আরও বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধে ১১৮ জনের নাম তালিকা থাকলেও ওই দিন কমপক্ষে ২৮০ থেকে ৩০০ জন শহীদ হয়েছিলেন।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও ভারপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার নুরুল হাই মোহাম্মদ আনাছ আজকের পত্রিকাকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় নিহতের গণকবরগুলো সরকার সংরক্ষণ ও সংস্কারে কাজ করছেন। এটা সারা দেশেই পর্যায়ক্রমে হচ্ছে। বিহারিপাড়ার গণকবরের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।