‘বর্ষাকালে সাধারণ নলকূপ ও শ্যালো মেশিনে পানি উঠছেনা। আমনের চাষাবাদ, পাট জাগ দেওয়ার মৌসুম চলছে। এ ছাড়া মানুষের দৈনন্দিন কাজকর্ম তো আছেই। বর্ষায় পানির জন্য মানুষের এমন হাহাকার আমার জীবনে দেখিনি, এমনকি কোনো দিন কারও কাছ থেকে কাছে শুনিওনি।’
এই কথাগুলো নাটোর বাগাতিপাড়ার বিলগোপালহাটি গ্রামের ৭০ বছর বয়সী সাবেক শিক্ষক আজাহার আলীর।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য দপ্তরের জরিপ অনুযায়ী, উপজেলায় প্রায় ২৬ হাজার সাধারণ নলকূপ ও সেচযন্ত্র রয়েছে। চলতি বছরে পানির স্তর ১০ থেকে ১৫ ফুট নিচে নেমে গেছে। স্থানভেদে ২৫ থেকে ৩৫ ফুট নিচে পানির স্তর রয়েছে। সাধারণ নলকূপ ও ডিজেল চালিত শ্যালোমেশিন সর্বোচ্চ ২৮ থেকে ৩০ ফুট গভীর থেকে পানি উত্তোলন করতে পারে। ফলে নলকূপ ও ডিজেল চালিত শ্যালোমেশিনে পানির সংকট দেখা দিয়েছে।
এ দিকে কৃষকের প্রতি বিঘায় আবাদ করা পাট জাগ দিতে পুকুর ভাড়া বাবদ ২ হাজার থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা দিতে হচ্ছে পুকুর মালিককে। আবার অনেকেই এক বিঘা জমিতে জলমোটর দিয়ে পানি সেচে ২ হাজার টাকা, জমি তৈরি ১ হাজার ৫০০ টাকা, চারা রোপণ ২ হাজার ২০০ টাকা, সার ১ হাজার ৭০০ টাকা এবং বিবিধ ৭০০ টাকা খরচ করে ধান রোপণ করেছেন। এখন সেই জমিগুলোতে পানির অভাবে সেই ধান নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছেন কৃষকেরা। ধানের জমি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে।
দেবনগর গ্রামের মিজানুর রহমান আজকের পত্রিকাকে জানান, জলমোটরের পানিতে সেচ দিয়ে সাড়ে তিন বিঘা জমিতে ধান রোপণ করেছেন তিনি। পানির অভাবে আরও তিন বিঘা জমিতে এখনো ধান রোপণ করতে পারেননি। এর মধ্যে রোপণ করা ধান নিয়ে এখন চরম বিপাকে পড়েছেন। সেগুলোতে নিয়মিত পানি সেচ দিতে হচ্ছে। আর কিছুদিন এভাবে চলতে থাকলে তাও সম্ভব হবে না। ফলে সেগুলোও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তাঁর।
বিলগোপালহাটি গ্রামের রাকাত আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার বাড়িতে চারটা গুরু আছে। বাড়ির টিউবওয়েলে পানি উঠছেনা। জলমোটর বসানোর মতো টাকাও নাই। নিজেদের খাবার পানিসহ গরুগুলার জন্য প্রতিদিন মসজিদের জলমোটর থেকে পানি টেনে আনা দুরূহ হয়ে পড়ছে।’
ক্ষিদ্রমালঞ্চি গ্রামের দিনমজুর লালন হোসেন বলেন, ‘আমন ধান চাষের জন্য দুই বিঘা জমি লিজ নিছিলাম। পাঁচ ফুট মাটি গর্ত করে সেখানে ডিজেল চালিত শ্যালোমেশিন বসিয়েও পানি তুলতে পারিনি। ধান লাগাতে না পারলে আমার অনেক লোকসান হবে।’
জালালপুর গ্রামের বাসিন্দা মোশাররফ হোসেন বলছেন, তাঁদের গ্রামের প্রায় ৮০ ভাগ মানুষের বাড়িতে পানি নেই। যাদের বাড়িতে জলমোটর রয়েছে, তাদের থেকে পানি নিয়ে কোনো রকমে চলছে গৃহস্থালির কাজ।
উপজেলা জনস্বাস্থ্য দপ্তরের উপসহকারী প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় স্তর দিন-দিন নিচে নেমে যাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে পানি অপচয় না করার জন্য উপজেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ থেকে মানুষকে সচেতন করা হচ্ছে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ভবসিন্ধু রায় আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘উপজেলায় চলতি মৌসুমে পাট চাষ হয়েছে ৩ হাজার ১৩০ হেক্টর জমিতে। আমন ধান চাষের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে ৫ হাজার ৪৬০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছরে উপজেলায় পাট জাগ দেওয়ার জন্য পানি সংকট থাকায় কৃষকদের রিবন রেটিং বিষয়ে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। আর আমন ধানের মৌসুম মূলত বৃষ্টি নির্ভর। সেই ক্ষেত্রে ধান রোপণের আরও কিছুদিন সময় রয়েছে।’ বাকি সময়ে বৃষ্টির ব্যাপারে আশাবাদী তিনি।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা সরকার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর সঙ্গে কথা বলে পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’