কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ গুলিতে-নাকি ইটপাটকেলে মারা গেছেন, তা নিয়ে বিতর্ক চলছে। পুলিশের দায়ের করা একটি মামলার পর এই বিতর্ক শুরু হয়। ভিডিওতে প্রকাশ্যে গুলি করার দৃশ্য দেখা গেলেও মামলায় বাদী উল্লেখ করেন, ‘বিভিন্ন দিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে একজন শিক্ষার্থীকে পড়ে যেতে দেখা যায়।’
বেরোবি শিক্ষকেরা বলছেন, আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি ভিন্ন খাতে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। তবে পুলিশ কমিশনার বলেছেন, এফআইআর চূড়ান্ত কিছু না, এটা তদন্ত শুরুর বিষয়মাত্র।
কোটা সংস্কার আন্দোলনের অংশ হিসেবে বাংলা ব্লকেডের কর্মসূচি চলাকালে গত ১৬ জুলাই দুপুর ২ টা ১৫ মিনিটের দিকে রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের–২ নম্বর গেটের সামনে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের ১২ ব্যাচের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ। গুলিবিদ্ধ হওয়ার দৃশ্য দেশি–বিদেশি গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়।
১৬ জুলাই আবু সাঈদের মৃত্যু নিয়ে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক মো. ইউনুস আলী গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘বিকেল সোয়া ৪টার দিকে হাসপাতালে ২৫ বছর বয়সের আবু সাঈদ নামে একটি রোগী আসে। সেটি ব্রথ ডেড ছিল। অর্থাৎ মৃত অবস্থায় আনা হয়েছিল। রাবার বুলেটের মতো অনেক আঘাতের চিহ্ন তার গায়ে ছিল।’
পরের দিন শিক্ষকেরা সাঈদের মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড দাবি করে সুষ্ঠু বিচার ও তদন্তের দাবিতে ক্যাম্পাসের–২ নম্বর গেটের সামনে মানববন্ধনও করেন। এ সময় তাঁরা গুলিকারী পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানান।
নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ১৬ জুলাই রাত ১১ টা ৩৫ মিনিটে আবু সাঈদের মৃত্যু ও সংঘর্ষের ঘটনায় তাজহাট থানায় এজাহার দাখিল করেন এসআই বিভূতি ভূষণ রায়। ১৭ জুলাই তারিখে মামলাটি রেকর্ড হলেও কপি থাকে আড়ালে। সেই মামলার কপি সম্প্রতি প্রকাশ্যে আসলে এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়।
এজাহারে বাদী উল্লেখ করেন, ‘বিভিন্নদিক থেকে আন্দোলনকারীদের ছোড়া গোলাগুলি ও ইটপাটকেল নিক্ষেপে একজন শিক্ষার্থীকে পড়ে যেতে দেখা যায়। তখন তার সহপাঠীরা তাকে ধরাধরি করে জরুরি চিকিৎসার জন্য বিকেল ১৫.০৫ ঘটিকার সময় রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন। মৃত ছাত্রের নাম আবু সাঈদ(২৩), পিতা- মকবুল হোসেন, সাং-জাফড়পাড়া বাবনপুর, থানা-পীরগঞ্জ, জেলা রংপুর।’
সাঈদের মৃত্যু নিয়ে পুলিশের এই লেখাতেই আপত্তি সবার। সহপাঠী, এলাকাবাসী, পিতামাতা, ভাই বোন, শিক্ষকেরা সবাই ক্ষুব্ধ।
গত শুক্রবার সকালে ক্ষতিগ্রস্ত বিটিভি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে আবু সাঈদ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও পুলিশের গুলির কথা উল্লেখ করেন।
নিহত আবু সাঈদের বড় ভাই রমজান আলী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার ভাইকে গুলি করে মেরেছে। গোসলের সময় তার শরীরে দুটি গুলির চিহ্ন দেখেছি। শুনেছি পুলিশ মামলায় গুলির কথা লেখে নাই। দেশবাসী সবার প্রতি অনুরোধ আমার ভাইয়ের হত্যার সঠিক বিচার যেন পাই।’
সাঈদের পিতা মকবুল হোসেন বলেন, ‘সাঈদ আমার সব ছিল। পুলিশ তাকে গুলি করে মেরেছে। সারা বিশ্ব দেখেছে তাকে কীভাবে গুলি করে মারা হয়েছে। গুলি করে হত্যা করে যে আমার বুক খালি করেছে, তার বিচার চাই। পুলিশ বা কেউ যাতে ঘটনা উল্টাতে না পারে সে জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাই।’
সাঈদের বোন সুমি বেগম বলেন, ‘আমি বিচার চাই, যে শয়তান আমার ভাইকে গুলি করে মেরেছে, তার আমি বিচার চাই।’
রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ড. তুহিন ওয়াদুদ বলেন, আবু সাঈদকে প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশ গুলি করেছে। সেই গুলিতে আবু সাঈদ নিহত হয়েছে। এটা একটা হত্যাকাণ্ড। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্ধৃতিতেও সেটা দৃশ্যমান। গুলিতে মৃত্যুবরণ করা আবু সাঈদের সেই ঘটনাটাকে যদি অস্বীকার করা হয়, ধামাচাপা দেওয়া হয়। তাহলে এটা আসলে হিতে বিপরীত হবে। এই ঘটনাকে যদি বলা হয় পুলিশের গুলিতে নিহত হয় নাই, তাহলে এটা সত্যের অপলাপ হবে। অন্যদিকে পুলিশ প্রশাসন যদি এটাকে বস্তুনিষ্ঠভাবে তদন্তের আওতায় না আনে তা হলে পুলিশ প্রশাসন সম্পর্কেও মানুষের নেতিবাচক ধারণা তৈরি হবে। আমরা মনে করি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী যেই বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। সেই কমিটির মাধ্যমে এর একটা বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তাবিউর রহমান প্রধানও বলেন, বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যে ভিডিও ফুটেজ দেখেছি, তা দেখে স্পষ্ট এটা কোনো স্বাভাবিক মৃত্যু নয়।
রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের প্রধান রাজিবুল ইসলাম আজকের পত্রিকাকে বলেন, খুব শিগগিরই ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন প্রস্তুতি করা হবে। মৃত্যুর প্রকৃত কারণ অবশ্যই সেখানে থাকবে। তখন সবাই দেখতে পারবেন কী কারণে তাঁর মৃত্যু হয়েছে।
তবে যোগাযোগ করা হলে কথা বলতে রাজি হননি মামলার বাদী তাজহাট থানার এসআই বিভূতি ভূষণ রায়।
বিভিন্ন মহলের ক্ষোভের বিষয়ে রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. মনিরুজ্জামান বলেন, এফআইআর হচ্ছে ফাস্ট ইনফরমেশন রিপোর্ট। এটার মধ্যে অনেক সময় ভুল থাকে। ত্রুটি থাকে। সকল তথ্য থাকে না। যখন এফআইআরটা হয়েছে, তখন কিন্তু পোস্ট মোর্টেম রিপোর্ট নাই। শুধুমাত্র সুরতহাল রিপোর্ট দেখেই এফআইআর হয়েছে। সকল ফুটেজ তখনো পাওয়া যায়নি। স্রেফ একটা ঘটনার বিবরণ দিয়ে এফআইআর হয়েছে। দিস ইস এ ডকুমেন্টস টু স্টার্ট ইনভেস্টিগেশন। এটা তো চূড়ান্ত কোন কিছু না।
পুলিশ কমিশনার বলেন, এফআইআর যাই হোক তদন্ত প্রক্রিয়াটি অবশ্যই আমরা প্রফেশনালী করার চেষ্টা করব। বিচারবিভাগীয় তদন্ত কমিশন গঠন হয়েছে, সেই কমিশনও এই বিষয়টি দেখবেন। তারা এই বিষয়ে তাদের মতামত দেবেন। আমি অনুরোধ করব। সকলে একটু ধৈর্য ধরুন। অপেক্ষা করুণ। আমাদের ওপর আস্থা রাখুন। আমাদের একটু সময় দিন। আমরা যে প্রক্রিয়ায় জানমালের ক্ষতি এড়ানোর চেষ্টা করেছি। যে প্রক্রিয়ায় কোনো নিরীহ মানুষকে ধরপাকড় করিনি। সেই প্রক্রিয়ায় তদন্তসহ ভবিষ্যতে সকল কার্যক্রম সম্পন্ন করব।
তিনি আরও বলেন, আইন অনুযায়ী সুরতহাল রিপোর্ট হয়েছে। এখনো ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি। এটা পেলে মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে পরিষ্কার জানা যাবে। এ ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয়েছে। তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষ হলে পুরো বিষয়টি পরিষ্কার হবে।