বদরগঞ্জ (রংপুর) প্রতিনিধি
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত সোমবার (৫ আগস্ট) দেশ ত্যাগের পর থেকে রংপুরের শিক্ষার্থীরাসহ সাধারণ মানুষ বিজয় উল্লাসে মেতে উঠেছেন। গভীর রাত পর্যন্ত চলছে নগরীতে গান-বাজনা। চলছে মিষ্টি বিতরণও। দীর্ঘ বছর ঝিমিয়ে থাকা বিএনপি, জামায়াতসহ তাদের অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরাও উজ্জীবিত হয়ে উঠেছেন। তাঁরাও বিজয় উল্লাসের পাশাপাশি আনন্দ মিছিল ও পথসভা করছেন।
এদিকে সরকারের পতন হওয়ার পর থেকে যখন সবাই আনন্দ-উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছেন তখনো রংপুরে অন্তত ১২টি পরিবারে কান্না থামছে না। সরকারের শুধু পতন নয়, নিহত পরিবারদের দাবি প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের এই হত্যা মামলার আওতায় এনে তাঁদের কঠোর বিচারের। গত ১৬ জুলাই থেকে ৪ আগস্ট পর্যন্ত রংপুরে আন্দোলনকারী ও পুলিশের পাল্টাপাল্টি ধাওয়া, সংঘর্ষ ও গুলিতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদসহ অন্তত ১২ জন নিহত হয়েছেন।
কোটা আন্দোলনের শহীদ আবু সাঈদের বাড়ি রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলা মদনখালীর বাবনপুর গ্রামে। আজ বুধবার আবু সাঈদের বাবা মকবুল হোসেনের সঙ্গে কথা হয় আজকের পত্রিকার এই প্রতিবেদকের। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বলেন, ‘যদি সরকার তাদের দাবি প্রথমেই মেনে নিত কিংবা পদত্যাগ করত, তাহলে তো আজ আমি বুকের ধন আবু সাঈদকে হারাতাম না। তাকে আর কোনো দিন ফিরে পারব না। সরকারের পতন দেখে কিছুটা হালকা হয়েছি। তবে আমি মরার আগে সন্তান হত্যার বিচার দেখে মরতে চাই। তাহলে মরেও কিছুটা শান্তি পাব।’
১৯ জুলাই রংপুর নগরীর সিটি বাজার এলাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন দোকান কর্মচারী মেরাজুল ইসলাম (৩৬)। তাঁর বাড়ি নগরীর নিউ জুম্মাপাড়া গ্রামে। তিনি স্ত্রী, বৃদ্ধ মা ও দুই ছেলেসন্তান রেখে গেছেন। মেরাজুলের স্ত্রী নাজমিম ইসলাম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার স্বামীর উপার্জনের টাকায় আমরা চলতাম। বড় ছেলের লেখাপড়া খরচও চলত তার উপার্জনে। সেই উপার্জনকারী স্বামীই তো আর নাই।’
তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘সরকার পতনের পর সবাই বিজয় উল্লাস ও মিষ্টি বিতরণ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমাদের খোঁজ কেউ নিচ্ছেন না। কী দোষ ছিল আমার স্বামীর?’
ওই দিন পাইকারি সবজি কিনতে গিয়ে একই স্থানে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছেন নগরীর পূর্বশালবন সাজ্জাদ হোসেন (২৮)। তাঁর উপার্জনে চলত বৃদ্ধ মা, স্ত্রী ও পাঁচ বছরের কন্যাসন্তান। সাজ্জাদের মা ময়না বেগম সন্তানের ছবি বুকে নিয়ে কেঁদে বেড়াচ্ছেন। রাতে তিনি ওই ছবি নিয়ে বিছানায়ও ঘুমাচ্ছেন।
ময়না বেগম বলেন, ‘সন্তানকে হত্যা করে মোর বুক যারা খালি করছে, তাদের বিচার করতে হবে।’
সাজ্জাদের স্ত্রী জিতু বেগম বলেন, ‘সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের দাবি আদায় হলো। অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোরও সুবিধা হলো। এখন সবাই গানবাজনা ও আনন্দ উল্লাস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন। কিন্তু আমার পাঁচ বছর বয়সী সন্তান সিনহা তার বাবাকে প্রতিদিন রাত খুঁজছে আর কাঁদছে। তাকে সান্ত্বনা দেবে কে?’
শুধু ওই তিন পরিবারে নয়, রংপুরে এই আন্দোলনে অন্তত আরও নয়জন নিহত হয়েছেন। নিহত হওয়া সেই পরিবারে চলছে কান্নার রোল।