‘আসমানীদের দেখতে যদি তোমরা সবে চাও, রহিমদ্দির ছোট্ট বাড়ি রসুলপুরে যাও। বাড়ি তো নয় পাখির বাসা...’ পল্লিকবি জসীমউদ্দীনের ‘আসমানী’ কবিতার সেই বাড়ি যেন একবিংশ শতাব্দীতেও এসে আবার ধরা দিয়েছে। রংপুরের পীরগাছায় জগৎপুর গ্রামের ৭৬ বছর বয়সের হামিদা বেগম ঘরটিতে বেড়া দিয়েছেন পরনের ছেঁড়া শাড়ি দিয়ে।
প্রায় ১০ হাত ঘরের জায়গাটুকুও তাঁর নয়, স্থানীয় একজন তাঁকে থাকতে দিয়েছেন। জীবন থেকে ৭৬ বছর পেরিয়ে গেলেও হামিদা বেগমের কপালে জোটেনি স্থায়ী কোনো মাথা গোঁজার ঠাঁই। ঝড়বৃষ্টি-রোদে এভাবেই ছেলের বউ ও দুই নাতিকে নিয়ে জীবন কাটছে হামিদা বেগমের।
ভিটেমাটিহীন হামিদা বেগম থাকেন পীরগাছার পারুল ইউনিয়ন পরিষদ থেকে ২০০ গজ উত্তরে প্রতিবেশী নাতি আনারুল ইসলামের বাড়ির এক কোনায়। মানসিক ভারসাম্যহীন একমাত্র সন্তান আব্দুল হামিদ, ছেলের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম, দুই নাতি শামীম ও সাকিবকে নিয়ে তাঁর সংসার। ছেলেকে বিয়ে দিয়ে সুখে থাকার আশাও ব্যথিত করেছে হামিদা বেগমকে। বৃদ্ধ বয়সে শরীর আর চলছে না তাঁর। স্বামীর গ্রামের মায়ায় পড়ে আজও তিনি বাস্তুভিটাহীন। শুধু বিধবা ভাতা ছাড়া তাঁর কপালে জোটেনি আর কোনো সরকারি সুযোগ-সুবিধা।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রতিবেশী ভ্যানচালক আনারুল ইসলামের বসতভিটার এক কোনায় ছোট্ট ১০ হাত টিনের চালা। তাতে নেই বেড়া, নেই দরজা। পরনের কাপড় দিয়ে ঘেরা ঘরটিতে রয়েছে ছোট একটি খাট। একটি ভাঙা টেবিলে রাখা কয়েকটি পাতিল। সেখানে থাকছেন ওই বউ-শাশুড়ি।
ছেলে আব্দুল হামিদের স্ত্রী মনোয়ারা বেগম আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমার স্বামী অর্ধপাগল। সে বাড়িতে থাকে না। আমি অসুস্থ শাশুড়ি, ছেলে শামীম (৮) ও সাকিল মিয়াকে (৬) নিয়ে এই ঘরে এক খাটেই গাদাগাদি করে রাত পার করি। বৃষ্টি-বাতাস হলে বৃষ্টির পানি ঢুকে বিছানা ভিজে যায়। তখন সারা রাত বসে থেকে রাত কাটাতে হয় আমাদের। আয়-রোজগারের লোক নাই। আমি মানুষের বাসায় কাজ করে যা পাই, তা দিয়ে খেয়ে না-খেয়ে কোনোমতে দিন পার করছি। কখনো কাজ না থাকলে উপোস থাকতে হয়। আশপাশের মানুষ মাঝেমধ্যে আমাদের খাবার দেয়।’
মনোয়ারা বেগম আরও বলেন, ‘আমাদের থাকার জন্য স্থায়ী একটি ঘরের ব্যবস্থা করে দেওয়ার জন্য সরকারসহ বিত্তবানদের সাহায্য কামনা করছি।’
স্থানীয় বাসিন্দা হারুন মিয়া আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমরা জন্মের পর থেকেই তাদের দেখছি। কোনো জমিজমা নেই। অন্যের জমিতে জীবন পার করছেন। তিনি এলাকার মায়ায় পড়ে কোথাও যেতে চান না।’
তুহিন মিয়া নামের অপর একজন বলেন, ‘বর্তমান যুগেও পরিবারটির যে করুণ দশা, তা খুবই দুঃখজনক। আমরা চাই তাঁর অন্তত একটা নিরাপদ ঘরের ব্যবস্থা হোক। দরিদ্রদের জন্য সরকারের দেওয়া সুযোগ-সুবিধা পেলে অন্তত খেয়ে-পরে বাঁচতে পারবে।’
এ বিষয়ে ওই ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য নুরুল আমিন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ওই পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরে যাওয়ার জন্য কয়েকবার বলা হলেও তিনি যেতে চাননি। আর ঈদের সময় তাঁকে ভিজিএফ চাল দেওয়া হয়।’
পারুল ইউপির চেয়ারম্যান তোফাজ্জল হোসেন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘আমি এখন একটু অসুস্থ। কেউ এ বিষয়ে আমাকে জানায়নি। এখন দেখি কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না।’
এ বিষয়ে পীরগাছা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নাজমুল হক সুমন আজকের পত্রিকাকে বলেন, ওই পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করলে বিষয়টি গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।