ঘড়ির কাঁটায় তখন ঠিক বিকেল ৫টা। হলুদ রঙের টিশার্ট-ক্যাপ পরা কয়েকজনকে দেখা গেল শাবল দিয়ে গাছের গায়ে আটকানো পেরেক, তারকাঁটা অপসারণ করতে। ঘণ্টা দেড়েকের পরিশ্রমে প্রায় দুই কেজি পেরেক ও তারকাঁটা সরিয়েছেন তাঁরা বিভিন্ন গাছ থেকে। গতকাল বুধবার রংপুর-ঢাকা-কুড়িগ্রাম মহাসড়কের তাজহাট এলাকায় রাস্তার ধারে দেখা যায় এ চিত্র। গাছ থেকে ব্যানার, ফেস্টুন, পেরেক ও তারকাটা অপসারণ করছিলেন কয়েকজন হিজড়া।
গাছে পেরেক মেরে সাইনবোর্ড না লাগাতে ২০০২ সালে জাতীয় সংসদে আইন পাস হয়েছে। সে আইনের প্রয়োগ নেই। সিটি করপোরেশন আইনে ১৯৯০-এর ৯২ ধারার ৪৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী যত্রতত্র পোস্টার-ব্যানারসহ প্রচারপত্র সেঁটে দেওয়া এবং গাছে সাইনবোর্ড লাগানো দণ্ডনীয় অপরাধ। নেই সে আইনেরও প্রয়োগ।
গত ২ মে থেকে রংপুর মহানগরে সব গাছ পেরেক, তারকাঁটামুক্ত করার কাজ নিয়েছে হিজড়াদের সংগঠন ন্যায় অধিকার ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন সংস্থা। এতে প্রতিদিন বেলা ২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত কাজ করছেন ১০-১২ জন হিজড়া। এই অভিযান চলবে যত দিন না তারকাঁটা অপসরণ শেষ হয়।
আন্তর্জাতিক পরিবেশবিষয়ক জার্নাল ‘এনভায়রনমেন্টাল ইন্টারন্যাশনালে’ প্রকাশিত গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাড়ির আশপাশে ৩০০ মিটার বা এক মাইলের পাঁচ ভাগের এক ভাগ দূর পর্যন্ত সবুজ পরিবেশ থাকলে স্ট্রোকের ঝুঁকি ১৬ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়।
কেন এই কাজ করছেন? জিজ্ঞেস করলে আজকের পত্রিকাকে তাঁরা বলেন, ‘গাছকে আমরা অনেক ভালোবাসি। অনেক সময় তারকাঁটার আঘাতে গাছের বড় ধরনের ক্ষতি হয়। গাছ মারা যায়। এ কারণে আমরা কাজটি করছি। আমরা এ কাজের পাশাপাশি গাছ লাগিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য ধরে রাখতে মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির কাজও করছি।’
যুক্তরাষ্ট্রের একদল গবেষক দেখিয়েছেন, গাছের আচ্ছাদন গ্রীষ্মকালে দিনের তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মতো কমাতে পারে।
পেরেক, তারকাঁটা মুক্ত করার কাজে আসা হিজড়া রতন, সেহেল, লাবণ্য, সানি আজকের পত্রিকাকে জানান, সংবিধান অনুযায়ী দেশের সব মানুষ সমান। তবু সমাজে তাঁরা প্রতিনিয়ত তুচ্ছতাচ্ছিল্যের শিকার হন। নিজ পরিবারেও অচ্ছুত ও অনাদৃত। তাঁরা চান তাঁদের দ্বারা দেশের মানুষের জন্য ভালো কিছু হোক। বৈশাখের শুরু থেকেই তীব্র খরতাপে কাঁপছে সারা দেশ। তাঁদের সংগঠনের পক্ষ থেকে রংপুর নগরের সব তারকাটা মুক্তকরণ অভিযানে নেমেছেন।
ন্যায় অধিকার ট্রান্সজেন্ডার উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি আনোয়ারা ইসলাম রানী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘পৃথিবীর মানুষের বেঁচে থাকার প্রধান উপাদান অক্সিজেন। গাছ ধ্বংস করা মানে নিজেকে ধ্বংস করা। বিভিন্ন সময় আমরা লোহার তারকাটা দিয়ে গাছের শরীরে ব্যানার, ফেস্টুন ও সাইনবোর্ড টাঙানোর মহোৎসবে মেতে উঠি। আমরা গাছ রোপণের পাশাপাশি গাছ থেকে পেরেক অপসারণের কাজ শুরু করেছি। পুরো নগরীর গাছ পেরেকমুক্ত করতে যত দিন সময় লাগবে তত দিন এই অভিযান চালু থাকবে। আমরা সচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে চেষ্টা করব এখন থেকে যেন রংপুর মহানগরে কেউ গাছে তারকাঁটা ব্যবহার করে প্রচার-প্রচারণা না করে।’
পরিবেশ নিয়ে কাজ করা সংগঠন গ্রিন ইকোর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক সঞ্জয় চৌধুরী আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘ব্যক্তি, সরকারি দপ্তর, বেসরকারি সংগঠন-সংস্থাসহ সব প্রতিষ্ঠান আন্তরিকভাবে এগিয়ে এলে এই সমস্যার সমাধান হতে পারে। লাগবে আইনের কঠোর প্রয়োগ। গাছে পেরেকবিদ্ধের বিরুদ্ধে কেউ কেউ কাজ করছেন জেনে ভালো লাগে।