ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে টানা ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে সিলেটের পাঁচটি উপজেলার ৩৬টি ইউনিয়নের লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন। প্রতিটি উপজেলারই অবস্থা বেহাল। আতঙ্ক আর উৎকণ্ঠার মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্র ও বাড়িতে দিন গুনছেন মানুষজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জেলার গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ উপজেলায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দী হয়ে আছেন। এখানকার বেশির ভাগ এলাকার ঘরবাড়ি বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। অনেকের ঘরের ভেতরে কোমর সমান পানি আবার অনেকের ঘর একেবারে ডুবে গেছে।
প্রধান সড়কগুলোতে পানি উঠে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। মানুষজন কোথাও বের হতে পারছেন না। নষ্ট হচ্ছে ঘরবাড়ির মালামাল। অনেকে ঘরের মালামাল রেখে আশ্রয়কেন্দ্রেও যাচ্ছেন না। ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে যাওয়াতে রান্নাবান্নারও সুযোগ নেই। নেই শুকনো খাবারও।
মানুষের বাড়িঘরে দ্রুত পানি ঢুকে পড়ায় অনেক মানুষ ঘরবন্দী হয়ে পড়েছেন। পর্যাপ্ত নৌকার অভাবে আশ্রয়কেন্দ্রেও অনেকে যেতে পারছেন না। আর নদ-নদীর পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে বইছে।
গৃহপালিত পশু-পাখি নিয়েও পড়েছেন বেকায়দায়। বৃদ্ধ ও শিশুদের নিয়ে চরম বিপাকে পড়েছেন বন্যাকবলিত এলাকাগুলোর মানুষ। বর্তমানে নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এতে করে এক অসহায়ত্ব বিরাজ করছে ওই সব উপজেলার প্রায় ৩৬টি ইউনিয়নে। এর মাঝে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্কের কারণে মানুষজন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছেন। দু-তিন ধরে বিদ্যুৎ না থাকার কারণে শহরে বা প্রবাসে থাকা আত্মীয়রা যোগাযোগ করতে না পেরে ছটফট করছেন।
কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। মানুষজন ইতিমধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছেন। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে পর্যটন কেন্দ্রের ১০০টি নৌকা রয়েছে মানুষজনকে উদ্ধারের জন্য।
কানাইঘাট উপজেলার একটি ইউনিয়ন বাদে বাকি আটটি ইউনিয়নের মানুষজন পানিবন্দী রয়েছেন। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন উঠেছেন। তবে কোনো প্রকার হতাহতের ঘটনা ঘটেনি।
আর জকিগঞ্জে ভারতের বরাক নদী দিয়ে আসা পাহাড়ি ঢলে সুরমা-কুশিয়ারা নদীর কয়েকটি স্থানে ডাইক ভেঙে চারটি ইউনিয়নের অন্তত ৪০–৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। সেখানে ৫৮টি আশ্রয়কেন্দ্র প্রস্তুত করা হয়েছে এবং মানুষজনও সেখানে আছেন।
এদিকে জেলার পাঁচটি উপজেলায় (গোয়াইনঘাট, জৈন্তাপুর, কোম্পানীগঞ্জ, কানাইঘাট ও জকিগঞ্জ) সমহারে ২০০ বস্তা করে ১ হাজার বস্তা শুকনো খাবার, ১৫ টন করে ৭৫ টন চাল, ৫০ হাজার টাকা করে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ প্রদান করা হয়েছে বলে জানিয়েছে জেলা প্রশাসন। এ ছাড়া জেলার ৫ হাজার ৬০১ হেক্টর জমির ফসল প্লাবিত হয়েছে।
পানিবন্দী মানুষকে উদ্ধারে প্রস্তুত রয়েছে সেনাবাহিনী। প্রয়োজন হলেই তারা তৎপরতা শুরু করবে বলে জানান সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোবারক হোসেন।
পানি বাড়ায় ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে কোম্পানীগঞ্জ উপজেলার সাদা পাথরসহ জেলার অনেক পর্যটনকেন্দ্র। এ অবস্থায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত পর্যটনকেন্দ্রগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।
সিলেট আবহাওয়া অফিস জানায়, আজ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ৩৬ দশমিক ২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। গত রাতেও প্রচুর বৃষ্টি হয়েছে। আগামীকাল বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনাও রয়েছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জানায়, আজ বেলা ৩টার দিকে সুরমা নদীর কানাইঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ১৪ দশমিক ৪৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছিল। এখানে বিপৎসীমা ধরা হয় ১২ দশমিক ৭৫ সেন্টিমিটার। কুশিয়ারার শেওলা পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৩ দশমিক শূন্য ৫ হলেও ১৩ দশমিক ২০ সেন্টিমিটার, অমলশীদ পয়েন্টে বিপৎসীমা ১৫ দশমিক ৪০ হলেও ১৭ দশমিক ৪২ সেন্টিমিটার, সারি নদীর সারিঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা ১২ দশমিক ৩৫ হলেও ১৩ দশমিক ১৮ সেন্টিমিটার, সারি-গোয়াইনের গোয়াইনঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমা ১০ দশমিক ৮২ হলেও ১১ দশমিক ৩৫ সেন্টিমিটার, ধলাই নদের ইসলামপুর পয়েন্ট দিয়ে বিপৎসীমা অতিক্রম করে ১০ দশমিক ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল।
পাউবো সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাশ জানান, গত ২৪ ঘণ্টায় (গতকাল বুধবার সকাল ৬টা থেকে আজ সকাল ৬টা পর্যন্ত) চেরাপুঞ্জিতে ৬৫০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। যার কারণে সিলেটের নদ-নদীর পানি বাড়ছে। বিভিন্ন পয়েন্টে প্রায় ২ সেন্টিমিটার করে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। পরিস্থিতির কবে উন্নতি ঘটবে, সেটা বলা যাচ্ছে না।
গোয়াইনঘাট ইউএনও মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, উপজেলার ৭০ ভাগের বেশি এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ২৬টি আশ্রয়কেন্দ্রে ২ হাজার ৩৫৬ জন মানুষ ও ৬৪৫টি গবাদিপশু আশ্রয় নিয়েছে। ১ হাজার ৬৬০ হেক্টর আবাদি জমির ফসল পানিতে নিমজ্জিত। ৩৪৩ বর্গকিলোমিটার এলাকা প্লাবিত হয়েছে। বন্যাদুর্গত মোট পরিবার সংখ্যা ৪২ হাজার ৯০০টি পরিবারের ২ লাখ ৪৫ হাজার ৯৫০ জন মানুষ পানিবন্দী রয়েছেন।
কোম্পানীগঞ্জ ইউএনও সুনজিত কুমার চন্দ বলেন, উপজেলার প্রায় ছয়টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠছেন। তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার জন্য প্রতিটি ইউনিয়নে নৌকা রয়েছে।
জৈন্তাপুর ইউএনও উম্মে সালিক রুমাইয়া বলেন, ‘রাতের অবস্থা ছিল খুবই ভয়াবহ। এখন দিনে পানি একটু কমতে শুরু করলেও আবারও শুরু হয়েছে বৃষ্টি। যার কারণে পানি আর ততটা কমছে না, এবং পরিস্থিতির উন্নতিও হয়নি। মানুষজন আশ্রয়কেন্দ্রের পাশাপাশি নিকটস্থ আত্মীয়স্বজনের নিরাপদ উঁচু স্থাপনাতেও আশ্রয় নিয়েছেন। আমরা যতটা সম্ভব সব জায়গায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছি। জেলা থেকে পাওয়া ত্রাণ ছাড়াও আমরা ঢাকা এবং অন্যান্য জায়গা থেকে ত্রাণ এনে সব মানুষের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করছি।’
কানাইঘাট ইউএনও ফারজানা নাসরীন বলেন, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের ৮টি ইউনিয়নই প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে মানুষজন উঠেছেন। সুরমা নদীর পানি কানাইঘাট পয়েন্টে বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে পানি। যত সময় যাচ্ছে, অবস্থা ততই বেহাল হচ্ছে।