বিশ্ব অর্থনীতির অস্থির পরিস্থিতি ও মূল্যস্ফীতির মতো চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল জাতীয় সংসদে ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেট প্রস্তাব করেছেন। ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকার বিশাল এ প্রস্তাবিত বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ঘাটতি মেটাতে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেবে সরকার, যার প্রভাব বেসরকারি বিনিয়োগ এবং সেই সূত্রে উৎপাদন ও কর্মসংস্থানের ওপর পড়বে বলে মনে করছেন পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর।
জাতীয় সংসদে আজ বৃহস্পতিবার দেশের ৫১তম এবং আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের ২৩তম জাতীয় বাজেট প্রস্তাব উপস্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। প্রস্তাবিত এ বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে ঘাটতির পরিমাণ ২ লাখ ৪৫ হাজার ৬৪ কোটি টাকা, যা মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৫ দশমিক ৪ শতাংশ। এ ঘাটতি মেটাতে ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকার ব্যাংকঋণ নেবে সরকার। এই ঋণের পরিমাণ চলতি অর্থবছরের (২০২১-২২) চেয়ে ২৯ হাজার ৮৮২ কোটি টাকা বেশি। চলতি অর্থবছরের বাজেটে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ৭৬ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার লক্ষ্য রয়েছে। ঘাটতি বাজেটের বাকিটা আসবে বিদেশি ঋণ থেকে, যার সুদহার আবার বেশি।
ঘাটতি বাজেটকে সমস্যা হিসেবে না দেখলেও ঘাটতি পূরণে নেওয়া ঋণের ব্যবহার এবং ব্যাংকিং খাত থেকে নেওয়া ঋণের কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়াকে বড় করে দেখছেন আহসান এইচ মনসুর। তাঁর মতে, দেশে ঘাটতি বাজেট কোনো সমস্যা নয়। তবে বাজেট ব্যবস্থাপনার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘বিশেষ করে ঋণ নিয়ে সেই অর্থের যথাযথ ব্যবহার করতে হবে।’
জাতীয় বাজেটের আয়ের উৎস হিসেবে থাকে কর, শুল্ক ভ্যাট ইত্যাদি। ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে কর ও কর বহির্ভূত রাজস্ব আয় ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) থেকে ৩ লাখ ৭০ হাজার এবং অন্যান্য উৎস থেকে ৬৩ হাজার কোটি টাকা আয়ের লক্ষ্য ধরা হয়েছে। ফলে এই বাজেট বিশেষভাবে এনবিআরের লক্ষ্য অর্জনের ওপর নির্ভর করবে।
ফলে ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে বলে মনে করছেন এই বিশেষজ্ঞ। প্রস্তাবিত বাজেটের ঘাটতি পূরণে নেওয়া দেশি-বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধেই শুধু ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে, যা মোট বাজেটের ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। এর মধ্যে ৭৩ হাজার ১৭৫ কোটি টাকা অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ, আর বিদেশি ঋণের সুদ ৭ হাজার ২০০ কোটি টাকা। এই ঋণ ও এর সুদ দুইই বোঝা হয়ে উঠতে পারে বলে মনে করছেন পিআরআইয়ের নির্বাহী পরিচালক।
ঘাটতি বাজেট পূরণে নেওয়া ঋণ ও এর ব্যবহার নিয়ে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ‘সরকার ঋণ করে ঘাটতি পূরণ করে। কিন্তু সুদে নেওয়া টাকার সূক্ষ্ম ব্যবহার হওয়াটা একেবারে জরুরি। টাকা নিয়ে ফেলে রাখা বা কম গুরুত্বপূর্ণ কাজে ফেলে রাখা বন্ধ করতে হবে। সব মিলিয়ে বিদেশি ঋণ বেড়ে যাচ্ছে। আর দেশে ব্যাংক খাত থেকে নতুন করে ১ লাখ ৬ হাজার কোটি টাকার ঋণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে, যার সুদহার ৮ শতাংশ। আর বিনা ঝুঁকিতে এবং কোন ব্যবস্থাপনা খরচ ছাড়া ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোও অতি উৎসাহী মনোভাব দেখায়। কারণ ঋণখেলাপিও হবে না। যদিও এতে ব্যাংকগুলো মারাত্মক দুর্বল হয়ে পড়ে। সরকার ঋণ নেওয়ায় ব্যাংকগুলো বেসরকারি খাতে বিনিয়োগে কম আগ্রহ দেখায়। ফলে বিনিয়োগ কমে যায়। উৎপাদন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে বাধা সৃষ্টি হয়।’
প্রস্তাবিত বাজেটে রেমিট্যান্স প্রবাহকে উৎসাহিত করতে আড়াই শতাংশ প্রণোদনা বহাল রাখার প্রয়োজন ছিল না বলেও মন্তব্য করেন এই অর্থনীতিবিদ। তাঁর মতে, ‘বিশেষ করে রেমিট্যান্সের প্রণোদনা বন্ধ করে সেখানকার প্রায় সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকা স্বল্প আয়ের ও দরিদ্র মানুষের মধ্যে বিতরণ করা যেত। কারণ, ডলারের দাম বাড়ায় তারা তো এখন ভালো দাম পাচ্ছেন। গত কয়েক মাসে ডলারের দাম ৬-৭ টাকা বেড়েছে। এতে তারাও ভালো দাম পাচ্ছে। তাহলে আড়াই শতাংশ প্রণোদনার তো প্রয়োজন পড়ে না।’
এ ছাড়া সরকার করোনায় ব্যাংকগুলোর সুদহার বেঁধে দিয়েছিল। এটিকে মুক্তবাজার অর্থনীতির সঙ্গে মানানসই বলে মনে করেন না আহসান এইচ মনসুর। তিনি বলেন, ‘মূল্যস্ফীতির সঙ্গে সামঞ্জস্য না রেখে সুদহারের ক্যাপ বেঁধে দিলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। এর সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে সীমিত ও স্বল্প আয়ের ভোক্তার ওপর।’
সব মিলিয়ে রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও সুষম উন্নয়ন বাস্তবায়ন সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হবে বলে মনে করেন তিনি। তিনি বলেন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক নিরাপত্তা, রিজার্ভ ও আর্থিক স্থিতিশীলতায় অধিক মনোযোগ দিতে হবে। এসব করতে পারলে দেশের উন্নয়নের সুফল মানুষ পাবে।’