বাংলাদেশের ব্যাটারিচালিত রিকশাগুলোর লেড-অ্যাসিড ব্যাটারি সম্পূর্ণ রিচার্জ হতে সময় নেয় ৭ থেকে ৮ ঘণ্টা। এ ছাড়া এসব ব্যাটারির আয়ুষ্কালও মাত্র ৬-৮ মাস। চার্জে বেশি সময় লাগার কারণে এসব ব্যাটারিচালিত রিকশা চালানোর সময়ও পাওয়া যায় কম। ফলে চালকের উপার্জনও কমে যায়। এ সমস্যা সমাধানে ব্যাটারি সোয়াপিং স্টেশন নিয়ে এগিয়ে এসেছে হার্ভার্ডের দুই শিক্ষার্থীর প্রতিষ্ঠান টাইগার নিউ এনার্জি। এখন থেকে এই প্রতিষ্ঠানের সোয়াপিং স্টেশনগুলো মাত্র কয়েক মিনিটে স্বল্প খরচে চার্জ ফুরিয়ে যাওয়া ব্যাটারি বদলে নেওয়া যাবে। আর এসব ব্যাটারি টিকবেও ৩ থেকে ৫ বছর।
হার্ভার্ডের স্নাতক শিক্ষার্থী নিকোল মাও (৩৩) এবং ইওয়েই ঝু (৩২) গত ৩ বছর ধরে বাংলাদেশের অন্যতম সফল স্টার্টআপ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। কোভিড মহামারির সময় বাংলাদেশে আটকে পড়ার পর থেকেই তাঁরা এই উদ্যোগ শুরু করেন। তাদের ব্যাটারি-সোয়াপিং নেটওয়ার্ক—যা মূল ব্যাটারিচালিত রিকশার জন্য তৈরি—দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে। আগামী বছর এটির স্টেশন সংখ্যা ১ হাজারে পৌঁছাবে। এসব স্টেশন থেকে সারা দেশে কয়েক লাখ তিন চাকার ব্যাটারিচালিত রিকশাকে সেবা দেবে।
টাইগার নিউ এনার্জির প্রধান নির্বাহী নিকোল মাও এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘এখানে চাহিদা প্রচুর। অর্থনীতির আকার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে অনেক মানুষ কর্মসংস্থানের সন্ধানে গ্রামাঞ্চল ছেড়ে শহরে আসছেন। এটি গতিশীলতার জন্য চাহিদা তৈরি করছে।’
ভারতের টুকটুক এবং থাইল্যান্ডের তিন চাকার যানগুলো প্রধানত পেট্রল বা প্রাকৃতিক গ্যাসে চললেও ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য শহরগুলোর তিন চাকার গাড়িগুলো প্রধানত বৈদ্যুতিক। তবে রিচার্জে দীর্ঘ সময় লাগা এবং এসব রিকশায় ব্যবহৃত লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে যাওয়ার পর ধ্বংস করা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও পরিবেশগত সমস্যার কারণ।
মূলত, এই বিষয়টি থেকে সম্ভাবনা দেখতে পান মাও ও ঝু এবং শুরু করে তাদের উদ্যোগ। এই চীনা জুটি ২০২১ সালে তাদের বসন্তকালীন ছুটির সময় বাংলাদেশে আসেন এক সপ্তাহের সফরে। কিন্তু সে সময় কোভিড-১৯ এর আকস্মিক প্রাদুর্ভাবে তাদের চীনগামী ফ্লাইট বাতিল হয়ে যায় এবং কয়েক মাসের জন্য আটকে পড়েন। সে সময় তাঁরা ঢাকার একটি হোটেলে অবস্থান করছিলেন। রাতে জুমের মাধ্যমে হার্ভার্ডের ক্লাস শেষ করতেন এবং দিনের বেলা স্টার্টআপের পরিকল্পনা করতেন।
মাওয়ের পরিবার চীনে একটি ব্যাটারি তৈরির কারখানার মালিক। আর এ কারণেই মূলত তারা বাংলাদেশে একই ব্যবসা শুরুর সিদ্ধান্ত নেন। চীন থেকে উপাদান আমদানি করে আরও টেকসই লিথিয়াম ব্যাটারি সংযোজন এবং তা স্থানীয় গ্রাহকদের কাছে বিক্রি করার পরিকল্পনা করেন।
টাইগার নিউ এনার্জির চিফ অপারেটিং অফিসার ঝু বলেন, ‘এটি একেবারেই পাগলামির মতো একটি ধারণা ছিল। আমরা নিজেরাই স্থানীয় কর্মী নিয়োগ, কারখানার জন্য জমি খোঁজা এবং কর্মীদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব নিয়েছিলাম।’
প্রাথমিক কাজ শুরুর পর তাঁরা শিগগির দেখতে পান যে, অনেক রিকশাচালক তাদের পণ্য কেনার জন্য একসঙ্গে ৪০০ ডলার খরচ করতে অনিচ্ছুক বা অক্ষম। যদিও তাদের তৈরি ব্যাটারিগুলো সাধারণ লেড-অ্যাসিড ব্যাটারির তুলনায় বেশি মাইলেজ ও টেকসই হওয়ার নিশ্চয়তা। এরপর তারা ব্যাটারি-সোয়াপিং পদ্ধতি চালু করার সিদ্ধান্ত নেন এবং ক্রমেই এটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
চালকেরা যখন তাদের ব্যাটারি কমে আসতে দেখেন তখন তারা একটি স্বয়ংক্রিয় সোয়াপিং স্টেশনে গিয়ে নতুন ব্যাটারি বদল করে নেন। পুরো প্রক্রিয়ায় ভয়েস নির্দেশনা দেওয়া হয় বলে প্রক্রিয়াটি আরও সহজ হয়ে যায় তাদের। স্টেশনগুলো স্থানীয় বিদ্যুৎ গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত এবং কিছু স্টেশনে সোলার প্যানেল রয়েছে যা চার্জিং প্রক্রিয়ায় সাহায্য করে এবং লোডশেডিংয়ের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে।
এই উদ্যোগের জন্য প্রতিষ্ঠাতারা ফিলিপাইনের এডিবি ভেঞ্চারস এবং সিঙ্গাপুরের ওয়েভমেকার পার্টনার্স থেকে প্রাথমিক বিনিয়োগ সংগ্রহ করেন। এর মাধ্যমে তারা একটি লিথিয়াম ব্যাটারি কারখানা চালু করেন এবং বাংলাদেশের অন্যতম অর্থনৈতিক কেন্দ্র চট্টগ্রামে প্রথম ১০০টি ব্যাটারি-সোয়াপিং স্টেশন স্থাপন করেন।
প্রতিষ্ঠানটি বর্তমানে ৩০ মিলিয়ন ডলার তহবিল সংগ্রহের প্রক্রিয়া চালাচ্ছে। নিকোল মাও জানান, ২০২৫ সালের পরে তাঁরা সারা দেশে অন্তত ২ হাজার স্টেশন স্থাপন করতে চান এবং আগামী বছর নেপাল ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও (যেখানে ই-বাইক জনপ্রিয়) এই উদ্যোগ সম্প্রসারণের করতে চান।
তবে এই স্টার্টআপের ক্ষেত্রে একটি চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশের অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। গত জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে দীর্ঘদিনের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকার এখন অর্থনীতি স্থিতিশীল করা এবং সুষ্ঠু বাজার কার্যক্রম উন্নীত করার দিকে মনোনিবেশ করছে।
এই বিষয়ে লাইটক্যাসেল পার্টনার্স নামে একটি অর্থনৈতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বলেছে, ‘এই পরিবর্তনের মধ্যেও বাংলাদেশের স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম সমৃদ্ধি লাভ করবে বলে বিশ্বাস করা হচ্ছে।’ প্রতিষ্ঠানটি আরও জানিয়েছে, ২০১৩ সাল থেকে স্থানীয় উদ্যোগগুলো প্রায় ১০০ কোটি ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে।
বাংলাদেশে কাজ করার দারুণ সুযোগ রয়েছে উল্লেখ করে নিকোল মাও বলেন, ‘চীন বা যুক্তরাষ্ট্রে এমন একটি এলাকা খুঁজে পাওয়া খুব কঠিন যেখানে মানুষের চাহিদা অপূর্ণ আছে। কিন্তু বাংলাদেশে, আমি সব সময় লোকদের বলতে শুনি, “আপনারা এমন কিছু করতে পারেন, যা আমাদের নেই”।’
তথ্যসূত্র: কানাডার সংবাদমাধ্যম বিএনএন ব্লুমবার্গ