ঈশ্বরদীর ঐতিহ্যবাহী বেনারসি তাঁতশিল্প নতুন করে প্রাণ ফিরে পাচ্ছে। ভারতীয় শাড়ির দৌরাত্ম্য, রং ও সুতার লাগামহীন মূল্যবৃদ্ধির কারণে মুখ থুবড়ে পড়া এই শিল্প এবার নতুন সম্ভাবনার আলো দেখছে। একসময় যা ছিল একটি ম্রিয়মাণ অধ্যায়, বর্তমানে তা আবারও ঘুরে দাঁড়ানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে। সম্প্রতি ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান হ্রাস পাওয়ায় তাঁতিদের মধ্যে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছে।
সম্প্রতি শহরের ফতেমোহাম্মদপুরে অবস্থিত দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ঈশ্বরদী বেনারসিপল্লি ও আশপাশের তাঁতশাল ঘুরে দেখা গেছে, তাঁতিরা আবারও কর্মচঞ্চল হয়ে উঠছেন। স্থানীয় বাসিন্দা, তাঁতের মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ১৯৬৫ সালের আগ থেকে ঈশ্বরদীর ফতেমোহাম্মদপুরে কাতান-বেনারসি শাড়ি তৈরির প্রচলন ছিল, যার মূল কারিগর ছিলেন এখানকার বিহারি সম্প্রদায়ের তাঁতিরা। স্বাধীনতার পর ঈশ্বরদীতে পর্যায়ক্রমে বেনারসি তাঁত কারখানার সংখ্যা বাড়তে থাকে, আর এখানকার শাড়ি ঢাকাসহ সারা দেশের বাজারে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। এমনকি বিদেশেও এসব শাড়ি রপ্তানি হতো।
সময়ের পরিক্রমায় ভারতীয় শাড়ির অনুপ্রবেশ, চোরাচালান ও আমদানি সহজলভ্য হওয়ায় ঈশ্বরদীর বেনারসি শিল্প মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে যায়, বহু তাঁতি পেশা বদল করতে বাধ্য হন। বর্তমানে ফতেমোহাম্মদপুরের ৫০০ তাঁতের অধিকাংশ বন্ধ হয়েছে কিংবা কোনোভাবে টিকে রয়েছে। এতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত দুই সহস্রাধিক শ্রমিক কর্মসংস্থান হারিয়েছেন।
এ অবস্থায় সম্প্রতি ভারতীয় শাড়ির চোরাচালান উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসায় তাঁতিদের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। নাদিম নামের এক তাঁতি জানান, ‘ভারতীয় শাড়ি অনুপ্রবেশের কারণে আমাদের শাড়ি বিক্রি হতো না। তবে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর সীমান্ত দিয়ে চোরাচালান কমেছে। ফলে এবার ঈদের বাজারে দেশীয় বেনারসির চাহিদা বেড়েছে।’
আরেক তাঁতি আনছার আলী বলেন, ‘বেনারসি শাড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় আমরা কঠিন সময় পার করেছি। কিন্তু ভারতীয় শাড়ির প্রবেশ বন্ধ হওয়ায় এখন ঈশ্বরদীর ফুলকলি, আনারকলি, নেট কাতান ও পিওর কাতান শাড়ির বাজার ফের চাঙা হতে শুরু করেছে। আমরা আশাবাদী, এই শিল্প আবারও ঘুরে দাঁড়াবে।’
শ্রমিকদের বক্তব্যেও নতুন আশার প্রতিধ্বনি শোনা গেছে। তাঁতশ্রমিকেরা জানান, ঈদকে সামনে রেখে তাঁতিরা নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করেছেন। বেনারসিপল্লির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. শাহ জামান বলেন, ‘তাঁতশিল্পের অবস্থা বেশ নাজুক। অনেক তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। তবে ঈদকে কেন্দ্র করে তাঁতিরা নতুন করে কাজে ফিরছেন। বেনারসিপল্লির ছয়টি কারখানার মধ্যে চারটি চালু রয়েছে, যা ইতিবাচক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিচ্ছে।’
এ শিল্পের পুনর্জাগরণের অন্যতম কারণ হলো, চোরাইপথে শাড়ি আমদানি হ্রাস। ফলে দেশীয় উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে, বিশেষত কাতান-বেনারসি ও কারচুপির কারুকাজের শাড়ির প্রতি ক্রেতাদের আগ্রহ বেড়েছে। শ্রমিকদের মতে, প্রতিটি শাড়ি তৈরি করতে তিন থেকে চার দিন লাগে এবং একজন শ্রমিক সপ্তাহে দুটি শাড়ি তৈরি করতে পারেন। এতে তাঁর আয় হয় দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা।
ঈশ্বরদীর বেনারসি শিল্পের এই নতুন সম্ভাবনা তাঁতিদের সুদূরপ্রসারী স্বপ্ন দেখাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে যে শিল্প প্রায় বিলুপ্তির পথে ছিল, সেটি আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। যদি সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়, তবে ঈশ্বরদীর ঐতিহ্যবাহী বেনারসি তাঁতশিল্প আবারও তার স্বর্ণযুগে ফিরে যেতে পারে।